Society

তিষ্ঠ ক্ষণকাল

মতানৈক্যের ফলে তর্ক হবে, কখনও সেই তর্কের মাত্রা চড়বে, ঝগড়াঝাঁটিও হতে পারে, সেটাও অজানা ছিল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২২ ০৪:২৭
Share:

অসহিষ্ণুতা।

তর্ক হোক, ঝগড়া নয়— সুস্থবুদ্ধির নাগরিকরা ইদানীং দিনের মধ্যে কত বার যে এই কথাটি ভাবতে বাধ্য হন, তার ইয়ত্তা নেই। পথেঘাটে, টেলিভিশনের পর্দায়, সমাজমাধ্যমের পরিসরে, সর্বত্র ক্রমাগত তীব্র আবেগে এবং উচ্চ কণ্ঠে কথা-কাটাকাটি শুনে শুনে কানে তালা লেগে যায়, কারও সঙ্গে মতে না মিললেই গলা ফুলে ওঠে, চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করে, কখনও কখনও আস্তিনও নিজের জায়গায় থাকে না। নানা মুনির নানা মত, এটাই চিরকাল স্বাভাবিক ছিল, আজও তা-ই আছে। মতানৈক্যের ফলে তর্ক হবে, কখনও সেই তর্কের মাত্রা চড়বে, ঝগড়াঝাঁটিও হতে পারে, সেটাও অজানা ছিল না। কিন্তু এখন ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রায়শই যে ভাবে উৎকট মূর্তি ধারণ করে, তা কার্যত ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই রোগ কেবল ঘরে নয়, বাইরেও প্রবল। বিশ্বব্যাপী তার প্রকোপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে, অতিমারি বললে অত্যুক্তি হবে না। কেউ কেউ হয়তো বা জেনে সুখী হতে পারেন যে, খাস বিলেতেও এই রোগের সংক্রমণ বাড়ছে— সুখ তো প্রায়শই ঈর্ষার উল্টো পিঠে বাস করে!

Advertisement

তবে হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ মহান ভারত বা সংস্কৃতি-গর্বিত পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কিঞ্চিৎ অগ্রবর্তী। ব্যাধিকে সেখানে ব্যাধি বলে শনাক্ত করা হয়েছে এবং শুরু হয়েছে তার প্রতিকারের উদ্যোগ। গোড়া কেটে আগায় জল ঢালার উদ্যোগ নয়, গোড়া থেকেই নজর দেওয়ার সুচিন্তিত প্রকল্প। ব্রিটেনে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীদের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ চালাচ্ছেন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা। তেরো থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা শিখবেন, একে অন্যের সঙ্গে একমত না হয়েও কী ভাবে সুস্থ বিতর্ক করা যায়, পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও সদ্ভাব বজায় রাখা যায়। উদ্যোক্তাদের আশা, অল্প বয়সে শুরু করলে সুফল মিলবে, নাগরিক সমাজে অসহিষ্ণুতা কমবে। আশা পূর্ণ হবে কি না, অভিজ্ঞতাই বলবে। কিন্তু, এই দৃষ্টান্ত অনুসরণযোগ্য, এমনকি অনুকরণেও দোষ নেই। কলকাতায় বিগ বেন বা মোমের পুতুলের সংগ্রহশালা বসানোর থেকে এমন অনুকরণ অনেক বেশি কাজের হতে পারে। কী ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে? বিশদ বিবরণের অবকাশ নেই, একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হচ্ছে, কথোপকথন বা তর্কবিতর্কের সময় কারও কথার মধ্যে কথা বলা তো চলবেই না, এমনকি এক জনের কথা শেষ হলেই অন্য জন মুখ খুলবেন না, এক মিনিট অপেক্ষা করবেন, তার পরে তিনি নিজের বক্তব্য উচ্চারণ করবেন।

আপাতদৃষ্টিতে অভ্যাসটি সামান্য। কিন্তু তার তন্নিষ্ঠ অনুশীলনে বড় রকমের উপকার হতে পারে। দু’টি প্রধান উপকার। এক, অন্যের কথা শুনতে শেখা, সে-কথার অর্থ ও যুক্তি অনুধাবন করতে শেখা, তার মূল্য বিচার করতে শেখা। দুই, নিজের চিন্তাকে যাচাই করে নেওয়া এবং নিজের বক্তব্যকে গুছিয়ে নেওয়া। যে কোনও আলোচনার পক্ষে এই দুই বিদ্যাই যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তা বলে বোঝানোর দরকার নেই। কিন্তু সচরাচর এই অভ্যাসকে সুষ্ঠু কথোপকথন চালানোর জন্য দরকারি সৌজন্য বলেই গণ্য করা হয়। এই অনুশীলন কেবল সৌজন্যের জন্যই আবশ্যক নয়, আত্মোন্নতির পক্ষেও বিশেষ সহায়ক। ভিন্ন মতকে মন দিয়ে শুনে তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের ধারণাকে নতুন করে বিচার করতে পারলে সেই ধারণাও অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত হয়ে উঠতে পারে। তার মূল্য কেবল কথোপকথন বা সৌজন্যের জন্য নয়, নিজের উত্তরণের জন্যও। বলা বাহুল্য, এই উত্তরণই যথার্থ শিক্ষার লক্ষ্য। প্রশ্ন একটাই। এ দেশে যাঁরা শিক্ষা নীতির নির্ধারক এবং যাঁরা সেই নীতি রূপায়ণের অধিকারভোগী, তাঁদের কাছে যথার্থ শিক্ষার আদৌ কোনও মূল্য আছে কি? স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি শিক্ষাকে যে যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা হচ্ছে, তার সঙ্গে প্রকৃত জিজ্ঞাসা, কৌতূহল, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদির কোনও সংযোগ নেই, বরং অনেকাংশেই বিরোধ আছে। এই শিক্ষাব্যবস্থার আসল লক্ষ্য হল ক্ষুদ্রস্বার্থসর্বস্ব ব্যক্তি নির্মাণ, যারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতার অনুগত জীবন যাপন করবে এবং ক্ষমতাবানদের নির্দেশিত পথে চলবে, ক্ষমতাবতীদের তালে তাল দেবে। অন্যের কথা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলে সেই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, অন্যকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নিজের কথা জোর গলায় বলে চলাতেই তার ব্যক্তিত্বের প্রমাণ। সুতরাং— তর্ক নয়, ঝগড়াই চলুক।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement