ফাইল চিত্র।
ডেমিস হাসাবিস নামটি বিজ্ঞানী মহলে পরিচিত নহে। তথাপি তিনি এবং তাঁহার সহযোগীরা যাহা করিতেছেন, তাহা বিজ্ঞান গবেষণায় নূতন পথের দিশা দেখাইতেছে। তাঁহাদের গবেষণা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধি লইয়া। বুদ্ধিবলে মনুষ্য জীবকুলে শ্রেষ্ঠ; বিবর্তন নামক যুদ্ধে সে অন্য সকল জীবকে পরাস্ত করিয়াছে এবং করিতেছে। মগজাস্ত্রই তাহার একমাত্র আয়ুধ। সেই আয়ুধ যন্ত্রে আয়ত্ত করা যায় কি না, তাহাই কৃত্রিম বুদ্ধি গবেষকদের লক্ষ্য। ২০১০ সালে হাসাবিস দুই বন্ধু শেন লেগ এবং মুস্তাফা সুলেমান-এর সহিত এক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন— মূলত ভিডিয়ো গেম নির্মাণের উদ্দেশ্যে। সংস্থার নাম দেন ‘ডিপমাইন্ড’। ২০১৬ সালে সংস্থাটি প্রথম পৃথিবীময় সংবাদে আসে বিশেষ এক উপলক্ষে। সংস্থাটির প্রস্তুত এআই আলফাগো মেশিন গো খেলায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লি সিডলকে পরাস্ত করে। গো দাবার ন্যায় সম্পূর্ণত বুদ্ধি-নির্ভর ক্রীড়া। দাবায় যেমন একটি চালের প্রত্যুত্তরে অনেক চাল সম্ভব, সেই-সেই চালের উত্তরে অনেক পাল্টা চাল, গো খেলায়ও তেমনই সম্ভব। খেলোয়াড়ের পটুত্ব নির্ভর করে চালের উত্তরে পাল্টা চালের বহু দূর বিস্তৃত শাখাপ্রশাখা হইতে সুবিধাজনক চালটি নির্ণয় করিবার উপর। সেই খেলায় এক জন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে পরাস্ত করা কম বড় সাফল্য নহে। যন্ত্রের নিকট লি সিডলের পরাজয় সঙ্গত কারণেই কৃত্রিম বুদ্ধির বিজয়বার্তা হিসাবে প্রচারিত হইয়াছিল। যেমন হইয়াছিল ১৯৯৭ সালে আইবিএম কোম্পানি-নির্মিত ‘ডিপ ব্লু’ যন্ত্রের কাছে দাবা খেলায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভের পরাজয়। এআই আলফাগো-র সাফল্যে ডিপমাইন্ড সংস্থাটির পক্ষে জবরদস্ত প্রচার হইলেও, উহাই হাসাবিস এবং তাঁহার সহযোগীদের সর্ববৃহৎ সাফল্য নহে। সেই কীর্তি স্থাপিত হইয়াছে গত বৎসর ডিসেম্বর মাসে।
ওই সময় ডিপমাইন্ড বিজ্ঞানে যে সমস্যার উপর আলোকপাত করে, তাহার পোশাকি নাম প্রোটিন ফোল্ডিং প্রবলেম। প্রোটিন জীবকোষের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কোষের কার্যত সমস্ত কাজে— শক্তি উৎপাদন, কোষের আহার-বিহার, এমনকি কোষের ক্ষতি মেরামতে— থাকে প্রোটিন। এক-একটি প্রোটিন ২০টি বা তদ্রূপ অ্যামিনো অ্যাসিডে গঠিত। জীবদেহে প্রতিনিয়ত এই রূপ হাজার হাজার প্রোটিন কার্যে নিযুক্ত থাকে। প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আকৃতি অতীব জটিল। মালার ন্যায় উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি প্রোটিনে সজ্জিত থাকে। এই হিসাবে একটি মাত্র প্রোটিনের আকৃতি হইতে পারে ১-এর পর ৩০০টি ০ বসাইলে যে সংখ্যা পাওয়া যায়, তত প্রকাণ্ড। অথচ, প্রোটিনসমূহের আকৃতি না বুঝা গেলে তাহাদের কার্যক্ষমতার হদিস পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীগণ এই কারণে এক-একটি প্রোটিনের আকৃতি বুঝিতে চাহেন। ত্রিমাত্রিক আকৃতি বুঝিতে অ্যামিনো অ্যাসিডের ভাঁজ বুঝিতে হয়। গত বৎসর ডিপমাইন্ড আবিষ্কৃত আলফাফোল্ড যন্ত্র কিছু প্রোটিনের ভাঁজ বুঝিতে সক্ষম হইয়াছে। ডিপমাইন্ডের পক্ষে ইহা এক বৃহৎ বৈজ্ঞানিক সাফল্য। যন্ত্রকে বুদ্ধিমান করিবার লক্ষ্যে ইহা এক প্রকাণ্ড পদক্ষেপ।
এ প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্যর রজার পেনরোজের কথা মনে পড়িতে পারে। তাঁহার দি এমপেররস নিউ মাইন্ড বইটির উপজীব্য: মনুষ্যের ন্যায় চিন্তাশক্তি যন্ত্র কদাপি আয়ত্ত করিতে পারিবে না। বুদ্ধি যদি চিন্তার ফসল হয়, তাহা হইলে কৃত্রিম বুদ্ধি যতই সাফল্য অর্জন করুক, কোনও দিনও মনুষ্যের বুদ্ধির সমকক্ষ হইবে না। পক্ষান্তরে, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞগণের বিশ্বাস, বুদ্ধির যতই জয়গান গাওয়া হউক না কেন, আদতে উহা গণনা ভিন্ন অন্য কিছু নহে— দাবা অথবা গো খেলার চাল-পাল্টা চাল হইল বুদ্ধির সারবস্তু। কম্পিউটারের পুরোধাপুরুষ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং একদা এই প্রশ্নে ভাবিত ছিলেন যে, যন্ত্র কি ভাবিতে পারে? তাঁহার সুযোগ্য উত্তরসূরি জন ফন নয়ম্যান যে কম্পিউটার তৈরি করেন, তাহা অ্যাটম বোমার হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা তৈরিতে কাজে লাগে। কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ফন নয়ম্যান বলিয়াছিলেন, এক দিন এই যন্ত্রের অভিঘাত অ্যাটম বোমাকেও ছাপাইয়া যাইবে। আজ কম্পিউটারের কর্মক্ষমতা দেখিয়া তাঁহার দূরদৃষ্টি প্রমাণিত হয়। যন্ত্র আজ এমন সব কার্য করে, যা পূর্বে কল্পনাতীত ছিল। ডিপমাইন্ডের ক্রিয়াকলাপ সম্ভব হইতেছে পদার্থবিদ্যার সহিত স্নায়ুবিজ্ঞানের সংমিশ্রণে। বুদ্ধি স্নায়ুর ব্যাপার। উল্লেখ্য, হাসাবিস পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। পিএইচ ডি করিয়াছেন স্নায়ুবিজ্ঞানে।