দেশভাগ বিষয়টি শোকের— উদ্যাপনের নয়।
ইতিহাসের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর রূপটি যদি দেখতে পাওয়া যেত, তা বোধ হয় হত প্রচণ্ড এবং নিষ্করুণ। তাঁর সেই সংহারমূর্তির পিছনে হয়তো মঙ্গলবাদ্য বাজত না, বাজত বিষাদসুর, কিংবা যুদ্ধদামামা। কেননা, ইতিহাস দেবীই কেবল সাকার রূপে চাক্ষুষ দেখিয়ে দিতে পারেন, মানুষ নামক প্রাণীটি তার পাশের মানুষের প্রতি কত চরম অবিচার করতে পারে, কত নির্লিপ্ত নির্দয় উদাসীনতায় এই সুন্দরশোভন বিশ্ববক্ষে নিমেষে বিষাদ ও ভয়ের আবহ রচনা করতে পারে। বারংবার ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটলেও মানুষ তার থেকে শিক্ষা নিতে পারে না। সে কেবল অনিয়ন্ত্রিত উন্মাদনায় সামনের দিকে ছুটে চলে, অবধারিত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। ভারতবর্ষের গত একশো বছরের ঘটনাবলি যেন ইতিহাসদেবীর এই ছবিই ফুটিয়ে তোলে। দেশের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির মহোৎসব পালন চলছে, এ দিকে সেই উৎসব-আঙিনায় পঁচাত্তর বছর আগেকার রক্তাক্ত বিষায়িত হৃদয়বিদারক দেশভাগ থেকে যাচ্ছে কখনও বিস্মৃত, কখনও উপেক্ষিত, কখনও ক্ষুদ্রীকৃত, এবং আশ্চর্য— কখনও এমনকি গৌরবান্বিত। কিছু দিন আগেই বাঙালি ইতিহাসবিদ মনে করিয়ে দিয়েছেন, দেশভাগ বিষয়টি শোকের— উদ্যাপনের নয়। চার পাশের এই উন্মার্গগামিতায় সুশিক্ষিত সুবিবেচনাসম্পন্ন নাগরিকের কেবল গভীর উদ্বেগই জন্মাতে পারে। তিনি বুঝতে পারেন, ১৯৪৭ সালের পর শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ পথ পেরিয়ে এসে বাস্তব গেছে পাল্টে। যে সব মানুষ সে-দিন দেশভাগের মর্মান্তিকতার সাক্ষী ও ভাগীদার ছিলেন, তাঁরা আজ নেই। যাঁরা আজ আছেন, তাঁদের কাছে সে-দিনের সেই হিমালয়াধিক ট্র্যাজেডি নেহাত নাটক-নভেল’এর মতো দূরবর্তী, অপ্রত্যক্ষ, এমনকি অস্পষ্ট। মানবিক দুর্নিয়তির কোনও ছবি আজ আর ভারতীয় নাগরিকের চিত্তপটে ধরা দেয় না। অদূর ভবিষ্যতে সেই অঘটনের শেষ স্মৃতিরেখাটুকুও হয়তো চিরবিলুপ্ত হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের নাগরিকের কাছে যে কয়েকটি তথ্য আবারও পৌঁছে দেওয়া জরুরি, তা হল— মানবেতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম স্থানচ্যুতি ও উদ্বাস্তু সঙ্কট ঘটেছিল ১৯৪৭ সালের এই দেশভাগ ঘটনায়। অন্তত কুড়ি লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন— যে সংখ্যা অবশ্যই সরকারি, তদুপরি আনুমানিক। প্রায় এক লক্ষ মহিলা শারীরিক ভাবে নির্যাতিত ও ধর্ষিত হয়েছিলেন। উর্বশী বুটালিয়া প্রমুখ গবেষক দেখিয়েছেন কী ভাবে নারীশরীর হয়ে উঠেছিল দেশভাগ-ভয়াবহতার প্রধান মঞ্চ, তাঁদের জীবিত বা মৃত শরীরে এঁকে দেওয়া হয়েছিল বিজেতার অভ্রান্ত চিহ্ন। এত পরিমাণ নারীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার নিদর্শন এই উপমহাদেশের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি, অন্য দেশের ইতিহাসেও নয়। নাৎসি জার্মানির যে ইহুদিনিধনের ভয়াবহতা সমস্ত বিশ্বকে আজও কাঁপিয়ে দেয়, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশভাগের বীভৎসতা তার তুলনায় আকারে ও প্রকারে কিছুমাত্র কম নয়— নির্যাতিতের সংখ্যা আরও অনেক গুণ বেশি। তার পরও সেই ঘটনার এমত বিস্মরণে ইতিহাসদেবীর কেমন চেহারা হতে পারেন, সহজেই অনুমেয়।
ঘটনা হল, দেশভাগকে কী ভাবে মনে রাখা উচিত, ভারতীয় রাষ্ট্র এটাই আজও স্থির করে উঠতে পারেনি। ঘোষিত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশটির পক্ষে দেশভাগের শোক ও ভয়াবহতাকে তুলে ধরার বিপদ বুঝতে অসুবিধে নেই। তা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের সাম্প্রদায়িক বোধকে উস্কে দিতে পারে। পাকিস্তানের সেই সমস্যা নেই, সে সাম্প্রদায়িক চেতনার উপর ভর করেই জন্মেছিল, সেই চেতনাকে বাহন করেই পথ চলতে চায়। এ দিকে ভারতের সমাজে ভয়াবহতাকে ঢেকে রাখার প্রচেষ্টায় ফল হয়েছে বিষম। কোথাও ইতিহাসের বিস্মরণ এক অনৈতিহাসিক উদাসীনতা তৈরি করেছে। কোথাও ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে শাসনকেন্দ্রে এসেছে এমন শাসক, যাঁরা দেশভাগকে মনে করেছেন আশীর্বাদ, হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানকে ভাঙতে চেয়েছেন স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতেও। ফলত এখন সেই শাসকের পছন্দসই হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শ আবার নতুন করে বাস্তুচ্যুতি ও অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে ধরে পরিকল্পিত ভাবে দেশভাগের ইতিহাসের রাজনৈতিক ফসল ঘরে তোলার প্রয়াস করছে। সব মিলিয়ে পঁচাত্তর বছর পর স্বাধীন ভারতে দেশভাগ-স্মরণের সামনে দাঁড়িয়ে ভারতীয় নাগরিকের যে বার্তা নেওয়ার কথা ছিল— তার বদলে শুরু হয়েছে যুগপৎ ইতিহাসের বিস্মৃতি ও কলুষায়ন উৎসব।