—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ফের প্রকাশিত হল বিশ্ব ক্ষুধা সূচক, ভারতের স্থান নামল আরও নীচে, এবং আবারও কেন্দ্রীয় সরকার ওই প্রতিবেদনকে নাকচ করল। জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের দু’টি অসরকারি সংস্থা নমুনা সমীক্ষার ভিত্তিতে এই রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট অনুসারে ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১২৬টি দেশের মধ্যে ১১১। গত চার বছরে ভারতের অবনতি ঘটেছে দ্রুত— ৯৪ থেকে ১০১ হয়ে গত বছর ছিল ১০৭। নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশের থেকেও পিছিয়েছে ভারত। কেন্দ্রের নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের দাবি, এই নমুনা সমীক্ষার পদ্ধতি ভ্রান্ত, এবং বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিশেষজ্ঞরাও অবশ্য মনে করেন, কেবল ক্ষুধার সূচক রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারতে অনাহার-অর্ধাহার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসা চলে না। এই রিপোর্ট, যা অনুসারে ভারতের নম্বর জুটেছে ২৮.৭, বস্তুত তৈরি করা হয় চারটি সূচকের ভিত্তিতে— কত শতাংশ মানুষের পর্যাপ্ত ক্যালরি জোটে না; জন্ম থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার; কত শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম; আর কত শতাংশ শিশুর ওজন উচ্চতার তুলনায় কম। এই রিপোর্ট প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে, তার পর থেকে ক্রমতালিকায় প্রতি বছর উন্নতি করছিল ভারত, কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে অবনতি ঘটতে থাকে। যে-হেতু সেই বছরই কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে নরেন্দ্র মোদী সরকার, তাই এই বিপরীত গতির পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধির সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক রিপোর্ট ও ভারত সরকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে দেশবাসীর মনে দ্বন্দ্ব জাগতে বাধ্য— ভারতে ক্ষুধার তীব্রতা তা হলে কতখানি, তা কি বাড়ছে না কমছে? সরকার বিনামূল্যে, বা সুলভে, বিপুল খাদ্যশস্য বিতরণ করা সত্ত্বেও কেন এই সঙ্কট? সূচকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, ভারতে ক্ষুধা ও শিশু-অপুষ্টির চিত্রটি উদ্বেগজনক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরাও। কেন্দ্রীয় সরকারের পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০১৯-২১) তথ্য থেকে দেখা গিয়েছিল, পাঁচ বছরের কম যাদের বয়স, তাদের মধ্যে বয়সের অনুপাতে উচ্চতা কম পঁয়ত্রিশ শতাংশেরও বেশি শিশুর, এবং ওজনের তুলনায় উচ্চতা কম প্রায় কুড়ি শতাংশের। শিশু-অপুষ্টির এই ছবি দুশ্চিন্তার কারণ, বিশেষ করে এই জন্য যে, চতুর্থ সমীক্ষার (২০১৫-১৬) তুলনায় পঞ্চম সমীক্ষায় উন্নতি হয়েছে সামান্য। ভারতে শিশুদের একটা বড় অংশ যে এখনও যথাযথ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অতি-শৈশবেই, সে বিষয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। বিশ্লেষণে দেখা
গিয়েছে, পরিবারগুলিকে আর্থনীতিক শ্রেণি অনুসারে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করলে দেখা যাচ্ছে যে, সর্বোচ্চ আয়ের কুড়ি শতাংশ পরিবারের মধ্যে বয়সের তুলনায় খর্বকায় শিশু যেখানে তেইশ শতাংশ, সেখানে দরিদ্রতম কুড়ি শতাংশের মধ্যে তা ছেচল্লিশ শতাংশেরও বেশি।
আর্থনীতিক শ্রেণিভেদ অনুসারে অপুষ্টির চিত্রে এতখানি বৈষম্য বিশ্বের কম দেশেই দেখা যায়। যা এই ইঙ্গিতই করে যে, রেশন, অঙ্গনওয়াড়ি-সহ অন্য সরকারি সহায়তা প্রকল্পগুলি অতিদরিদ্র ও দরিদ্রদের যথাযথ সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। ক্ষুধা সূচক নির্মাণের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু তার থেকে বড় প্রয়োজন ভারতে শিশুর ক্ষুধা, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য ও পরিচর্যার অভাবের প্রকৃত চিত্রটি, গ্রাম ও শহর, রাজ্য, জনগোষ্ঠী ও খাদ্যাভ্যাসের নিরিখে যথাসম্ভব স্পষ্ট করে তোলা। তাতে বিরোধীদের অস্ত্র জোগানো হবে, এই ভয়ে সরকার
নিরস্ত হতে পারে না। কেবলই বিনামূল্যে খাদ্যশস্যের বিতরণ পুষ্টিতে উন্নতি না-ও আনতে পারে। শিশু ও মায়ের খাদ্যসুরক্ষা ও পরিচর্যার ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করতে প্রয়োজন তথ্য।