— ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন, সেই যুগে রাজ্যের কোনও এলাকায় কোনও অঘটনকে কেন্দ্র করে সরকার বা শাসক দলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটলে প্রায়শই তিনি কালক্ষেপ না করে সেখানে উপস্থিত হতেন এবং সহকর্মী তথা অনুগামীদের নিয়ে শাসকের বিরোধিতায় উচ্চকণ্ঠে সরব ও বীরবিক্রমে সক্রিয় হতেন। বস্তুত, যে কোনও অশান্ত অকুস্থলে এই সশরীর অভিযান ছিল তাঁর কর্মযোগের নিত্য কর্মপদ্ধতি, দীর্ঘদিন ধরে যার একাগ্র অনুশীলন তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যের এক প্রধান প্রকরণ হিসাবে স্বীকৃত। সেই সাফল্যের সুবাদে তিনি রাজ্যপাট অর্জন করেছেন। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের বয়স ইতিমধ্যে বারো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তাঁর সরকার, প্রশাসন এবং পুলিশ এখন যে ভাবে অশান্ত সন্দেশখালি ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিরোধীদের গতিপথ রোধ করতে বদ্ধপরিকর, তা দেখলে এক যুগ আগেকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী বলতেন, সে বড় সহজ প্রশ্ন নয়।
আজ অবশ্য তিনি এবং তাঁর পারিষদবৃন্দ অম্লানবদনে জবাব দেবেন: বিরোধী বা প্রতিবাদীরা সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির মতলবে উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় জল ঘোলা করতে যাচ্ছেন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার মৌলিক দায়িত্ব পালনের জন্যই প্রশাসন তাঁদের নিরস্ত করছে, এটাই রাজধর্ম। প্রশাসনের দায়িত্ব পালনের নামে প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং কর্মসূচিকে দমন করার এই সওয়াল নতুন কিছু নয়, বামফ্রন্ট জমানাতেও এই কুযুক্তি বিস্তর শোনা যেত, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই তা বিস্মৃত হননি। কিন্তু তাঁর জমানাতে বিরোধী-দমনের এই প্রশাসনিক উদ্যোগ এমনই একটি মাত্রায় পৌঁছেছে, যে আদালতকে বারংবার তার প্রতিকারে তৎপর হতে হচ্ছে। অশান্তির প্রথম পর্বে রাজ্য প্রশাসন গোটা সন্দেশখালি এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার যে নির্দেশ দিয়েছিল, হাই কোর্ট তা পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়েও বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের অভিযান আটকানোর জন্য পুলিশের অতি-তৎপরতার প্রতিকারে আদালতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজধর্মের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধ করে প্রশাসনকে সেই ধর্ম পালনে বাধ্য করাই অধুনা— কেন্দ্রের মতোই— রাজ্যেও আদালতের একটি বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্দেশখালি তার নতুন নজির।
বিরোধী রাজনীতিক, সামাজিক সংগঠন, মানবাধিকার কর্মী, সচেতন নাগরিক— গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকলেরই অধিকার আছে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, তাঁদের অভিযোগ শোনার, তাঁদের নিপীড়নের প্রতিবাদ করার, সেই অন্যায়ের প্রতিকারে সরব ও সক্রিয় হওয়ার, অপরাধীদের উচিত শাস্তি বিধানের জন্য প্রশাসনকে চাপ দেওয়ার। কেবল অধিকার নয়, এই প্রত্যেকটি কাজ তাঁদের কর্তব্য। তাঁরা যাতে সেই কর্তব্য পালন করতে পারেন, গণতান্ত্রিক প্রশাসনকেই তার উপযোগী পরিবেশ সরবরাহ করতে হয়। প্রতিবাদের নামে হিংস্র আচরণ বা অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হলে অবশ্যই সরকার তা প্রতিহত করবে। কিন্তু বিরোধীদের গতি ও কণ্ঠ রোধ করাই শাসকের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালে গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হয়। এই রাজ্যে সেই লাঞ্ছনার মাত্রা অনেক দিনই চরম আকার ধারণ করেছে। এমনকি নির্বাচনের সময়, বিশেষত (রাজ্য প্রশাসন চালিত) পঞ্চায়েত নির্বাচনে, বিভিন্ন এলাকায় বহু নাগরিককে কার্যত ভোট দিতে দেওয়া হয় না। প্রশাসনের প্রতি যে তীব্র বিরাগ ও ক্ষোভ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সন্দেশখালিতে দেখা যাচ্ছে, তার পিছনে এই ধারাবাহিক অধিকার-হরণের নিহিত ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। শাসকরা যদি ভেবে থাকেন, অকুস্থলে কেবল মন্ত্রী সান্ত্রি কিংবা নানা বশংবদ সংস্থা বা গোষ্ঠী পাঠিয়ে এই অস্থির জনরোষসন্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দেবেন, তবে বুঝতে হবে তাঁরা দেওয়ালের লিখন পড়তে ব্যর্থ। কেবল গণতান্ত্রিক নৈতিকতার স্বার্থে নয়, নিজেদের নৈতিক স্বীকৃতি ফিরে পাওয়ার স্বার্থেও তাঁরা অবিলম্বে আত্মসংশোধন করুন।