—প্রতীকী ছবি।
অভিধানে সব কথা লেখা থাকে না। যেমন, অভিধান অনুসারে, ‘উপদেষ্টা’ শব্দটির সরল অর্থ: যে উপদেশ দেয়। অর্থটি ভুল নয়, কিন্তু জীবনও সরল নয়। এই জটিল সত্যটি অভিধানে লেখা নেই যে, হীরক রাজ্যের গনতকারের মতোই অনেক রাজ্যে বা দেশে সরকারি নায়কনায়িকাদের উপদেষ্টারা কী উপদেশ দেবেন তা স্থির করার জন্য ওই নায়কনায়িকাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। অর্থাৎ, গদি-স্থিত নেতা বা নেত্রীকে কী উপদেশ দিতে হবে, তাঁরাই সে-কথা উপদেষ্টাদের জানিয়ে দেন, ওঁরা সেই আজ্ঞা পালন করেন। দুষ্ট লোকে বলে থাকে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে এবং ভারতে নাকি এই নিয়মই বহাল আছে। দুষ্ট লোকের কথা উড়িয়ে দেওয়া গেলেই ভাল হত, কিন্তু ঘটনার ঘনঘটা বারংবার রটনাকে প্রবল ভাবে সমর্থন করে। যেমন ধরা যাক, দেশের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের কয়েক জন সদস্যের সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টটির কথা। তাঁরা সেখানে ‘দেখিয়েছেন’, ১৯৫০ থেকে ২০১৫ অবধি সাড়ে ছয় দশকে দেশের জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত ৮৪.৬৮ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮.০৬ শতাংশে, মুসলিমদের অনুপাত বেড়েছে ৯.৮৪ শতাংশ থেকে ১৪.০৯ শতাংশে।
এই পরিসংখ্যান ‘দেখানো’র কিছু ছিল না, কারণ এটি অজানা তো নয়ই, বরং একেবারেই পুরনো তথ্য। যাঁরা এই বিষয়ে সামান্য ওয়াকিবহাল তাঁরাও বিলক্ষণ জানেন, এই পরিসংখ্যান অতীতের গল্প বলে, ভবিষ্যতের কথা জানায় না। তার কারণ, ইতিমধ্যে দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধি-হারও কমে এসেছে; শুধু তা-ই নয়, (১৯৮১ থেকে ২০১১-র জনশুমারি অনুসারে) হিন্দুদের তুলনায় মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি বেশি হারে কমেছে। বস্তুত, সামগ্রিক ভাবে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর সমস্যা নয়, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি যে কয়েকটি রাজ্যে জন্মহার এখনও বেশি, সেখানেও এই সমস্যার সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদের কোনও সম্পর্ক নেই, ওই রাজ্যগুলিতে আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন, বিশেষত স্ত্রীশিক্ষা এবং জনস্বাস্থ্যের প্রসার ঘটাতে পারলেই জন্মহার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই দ্রুত কমে আসবে। এক কথায়, স্বাধীন ভারতে মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর তুলনায় বেড়েছে— এই তথ্যটি এখন অপ্রাসঙ্গিক। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিষদ সহসা এই বস্তাপচা পরিসংখ্যান নিয়ে নতুন ‘পেপার’ সম্প্রচারে উৎসাহী হয়ে উঠল কেন?
বোধ করি তাঁদের ঠিক এমনটাই করার উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। কেন এই অনুমান? উত্তর সহজ ও সুপরিচিত: ‘ক্রোনোলজি’ বুঝে নিন। লোকসভা ভোটের প্রথম দু’টি পর্বের পরে (দুষ্ট লোকের মতে বেগতিক দেখেই) প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সতীর্থরা তাঁদের দল তথা সঙ্ঘের আদি ও অকৃত্রিম সূত্রটিকেই নির্বাচনী প্রচারের প্রধান অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করতে ব্যস্ত হয়েছেন। তার নাম: হিন্দু বনাম মুসলমান। প্রধানমন্ত্রী নিজে এ-বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিমদের হাতে হিন্দুদের সম্পত্তি, মায় মঙ্গলসূত্র অবধি তুলে দেওয়ার সম্পূর্ণ অসত্য এবং ভয়ানক রকমের অন্যায় অভিযোগ করেছেন। এবং এই উৎকট প্রচারের সময় তিনি স-হুঙ্কার ঘোষণা করতে ভোলেননি সনাতন অরণ্যের সেই প্রাচীন ও কুরুচিকর প্রবাদ: ‘যাদের সন্তান বেশি’ ইত্যাদি। অতঃপর ঝোপ বুঝে প্রকাশ করা হল উপদেষ্টাদের ‘গবেষণাপত্র’, এবং অবিলম্বে সেই পত্রটিকে কাজে লাগিয়ে তারস্বরে বহুশ্রুত প্রচার শুরু হয়ে গেল নতুন উদ্যমে, যে প্রচারের সার কথা: হিন্দু খতরে মে হ্যায়! এমন সরাসরি বিদ্বেষী প্রচারের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনও কঠোর বা কার্যকর পদক্ষেপ করবে, বর্তমান ভারতে সে গুড়ে বালি। ভরসা বলতে দেশের সাধারণ মানুষ তথা ভোটদাতা। তাঁরা এই বিভাজনের উপদেশ শুনে কাকের পিছনে ছুটবেন না নিজেদের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি অনুসরণ করবেন, ভারতীয় গণতন্ত্র আপাতত তারই মুখ চেয়ে আছে।