‘গ্রুপ সি’ শিক্ষাকর্মী পদে সুপারিশপত্র নিতে ১০০ জনকে ডাকা হলে এসেছেন মাত্র ৫৫ জন, ‘গ্রুপ ডি’ পদে ৪০ জনের মধ্যে এসেছেন ১২ জন। প্রতীকী ছবি।
সরকার বা সরকার নিয়োজিত সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কি তবে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে? এক দিকে স্কুলে চাকরি তথা নিয়োগের জন্য আন্দোলন চলছে, অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে উল্টো ছবি: ইন্টারভিউ-এ আগত প্রার্থীর সংখ্যা কম, এমনকি চূড়ান্ত নিয়োগপত্র দেওয়ার আগে যে সুপারিশপত্র দিয়ে থাকে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি), সেটা নিতেও আসছেন না যোগ্য প্রার্থীরা। খোদ এসএসসি-রই সূত্রে জানা যাচ্ছে, ‘গ্রুপ সি’ শিক্ষাকর্মী পদে সুপারিশপত্র নিতে ১০০ জনকে ডাকা হলে এসেছেন মাত্র ৫৫ জন, ‘গ্রুপ ডি’ পদে ৪০ জনের মধ্যে এসেছেন ১২ জন, এমনকি নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক পদে ৬৮ জনের মধ্যেও সবাই আসেননি! শীর্ষ আদালতের নির্দেশে এই মুহূর্তে গ্রুপ সি ও ডি-র নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত আছে বটে, কিন্তু এই সমগ্র চিত্রটি তুলে ধরে এক গভীর অনাস্থা— এসএসসি-র উপরে তো অবশ্যই, সার্বিক ভাবে রাজ্য সরকারের উপরেও। প্রথমে স্কুলশিক্ষক ও পরে শিক্ষাকর্মী নিয়োগে এমন বিপুল দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারি উঠে এসেছে যে, চাকরিপ্রার্থীরা এই বিশ্বাসটুকুই হারিয়ে ফেলেছেন— সাধারণ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের সরকার-নিয়ন্ত্রিত স্কুলে চাকরি পাওয়া যায়। ইন্টারভিউ-এ, বা সুপারিশপত্র নিতে না আসা আসলে মানুষের সেই হতাশা, রাগ, দুঃখ, ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
শুধুই কি তা-ই? এই আস্থাহীনতা এক গভীর সঙ্কটকেও সূচিত করে। সরকারের কাজ ও আচরণের প্রতি বিরক্তি এক জিনিস, কিন্তু সরকারি প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের এ-হেন অনাস্থা সরকার ও নাগরিক কারও জন্যই ভাল কথা নয়। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, পারস্পরিক আস্থার উপরে যেমন সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক স্থিতি দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনই সরকারের প্রতি নাগরিকের আস্থার উপরে নির্ভর করে প্রশাসনের ভারসাম্য। নাগরিকের আস্থা বা ‘পাবলিক ট্রাস্ট’ দৃঢ় থাকলে তবেই মানুষ সরকার তথা প্রশাসনের বহুবিধ নীতি মন দিয়ে মেনে চলেন— তা-ই ফুটে ওঠে জনস্বাস্থ্যের প্রতিক্রিয়ায়, সরকারি নির্দেশিকা পালনে, এমনকি করব্যবস্থায়। প্রশাসনের প্রতি আস্থায় মানুষের সচেতন রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ে, বাড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ‘এজেন্সি’গুলির বিশ্বাসযোগ্যতাও। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার ও নাগরিকের মধ্যে আস্থার ভারসাম্য থাকলে উন্নয়নের কাজ হয় দ্রুত ও মসৃণ, মানুষ এগিয়ে আসেন অনেক বেশি, উৎপাদনশীলতায় তার সুফল মেলে। অন্যথায় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কিন্তু এই সবই তো তত্ত্ব। তার প্রয়োগ না হলে, উপরন্তু অপপ্রয়োগ হলে কী দশা হয়, তার প্রমাণ আজকের পশ্চিমবঙ্গ। নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম-বেনিয়ম বা দুর্নীতি নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকার স্কুলশিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগে এমন দুর্নীতি করেছে যে, তার অভিঘাত হয়েছে মারাত্মক। প্রার্থীদের আন্দোলন, ধর্না, পথে নামা, সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ইত্যাদি যদি তার টালমাটাল বহিরঙ্গ হয়, ভিতরের রূপটি বিশ্বাসভঙ্গের আঘাতে দীর্ণ, যেন ক্রমাগত ঘা খেতে-খেতে হাল ছেড়ে-দেওয়া। প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকের অনাস্থার দিকনির্দেশটি সরকার নিজেই দেখিয়ে দিয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি করে। সরকার এক দিন নিয়মমতেই পাল্টাবে, কিন্তু সরকারের কাজের প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা কি এর পর থেকে থাকবে আর?