—প্রতীকী ছবি।
যে বানর তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠতে গিয়ে কেবলই পিছলে নেমে যায়, লিঙ্গসাম্যের প্রশ্নে এ দেশের দশা সেই জীবটির সঙ্গে তুলনীয়। মান্যগণ্য পেশাদারদের একটি সভায় মহিলা শ্রোতাদের প্রথম পাঁচ সারি আসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, কারণ আমন্ত্রিত বক্তাটি মহিলাদের দেখতে অনিচ্ছুক। দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইন্ডিয়া (আইসিএআই)-র বার্ষিক সভার এই ঘটনা গোটা রাজ্য, তথা দেশের লজ্জা তো বটেই, তবে এ যেন বিশেষ করে কলকাতার কলঙ্ক। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে শহরে বাস করেছেন, যে শহর জাতির ইতিহাসে নারী-অধিকার আন্দোলনে অগ্রগণ্য, সেই শহরের কোনও সভায় এক পুরুষের অযৌক্তিক, অনৈতিক ইচ্ছায় মহিলাদের সর্বসমক্ষে অসম্মান করা হচ্ছে, তাঁদের জন্য পিছনের সারি ধার্য করা হচ্ছে— এ যেন অবিশ্বাস্য। এ ঘটনা যেমন কুৎসিত, তেমনই ভয়াবহ। এই ঘটনায় মহিলাদের প্রতি যে অবমাননা প্রদর্শিত হয়েছে, তার গুরুত্ব কোনও ভাবেই লঘু করে দেখা চলে না। সংবাদে প্রকাশ, আইসিএআই-এর শীর্ষ কর্তারা এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন এবং ঘটনার অনুসন্ধান শুরু করেছেন। এই প্রতিক্রিয়া নিরাশাজনক। মহিলা শ্রোতা ও স্বেচ্ছাসেবীদের পিছনে সরে যেতে বলার ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে, ঘটনার সত্যতা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন সন্দেহ প্রকাশ করেনি। সভায় যা আচরণীয়, তা-ই সভ্য আচরণ। মহিলাদের সরে যেতে বলার মতো ‘অসভ্য’ আচরণ যে-ই করে থাক না কেন, আইসিএআই-এর সভায় যে-হেতু এ ঘটনা ঘটেছে, সে-হেতু দেশের সমস্ত মহিলার কাছে, বিশেষ করে সে দিনের সভার মহিলা শ্রোতাদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা দরকার আইসিএআই কর্তৃপক্ষের।
তবে ওই দিন যে সব মহিলা-শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা যদি বিনা প্রতিবাদে সামনের আসন ছেড়ে পিছনের সারিতে চলে যেতে সম্মত হয়ে থাকেন, তবে তর্জনী ওঠে তাঁদের প্রতিও। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির দুরূহ শিক্ষাক্রম যাঁরা অতিক্রম করেছেন, যাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত, তেমন মেয়েরাও যদি মেয়েদের অসম্মানের প্রতিবাদ না করেন, তা হলে কাদের উপর ভরসা করবে দেশের নারীসমাজ? অন্যায়কারীর মতো অন্যায় সহনকারীও সমান অপরাধী। কেবল মিছিল করেই অধিকার রক্ষার আন্দোলন হয়, এমন তো নয়। একক ব্যক্তির দৃঢ় আচরণেও তা হতে পারে। রোজ়া পার্কস নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা তাঁর বাসের আসনটি ছাড়তে অসম্মত হয়েছিলেন, তা থেকে এক যুগান্তকারী আন্দোলন শুরু হয় আমেরিকায়। সেই ঘটনার পরে প্রায় সত্তর বছর অতিক্রান্ত। আজ কেন এত সহজে নিজের আসন ছাড়বেন মেয়েরা?
সভার নিয়ম অবশ্যই মান্য। কিন্তু আয়োজকের নির্দেশ কখন শৃঙ্খলার প্রয়োজন ছাপিয়ে অন্যায় আবদারে পৌঁছে যাচ্ছে, বৈষম্য তৈরি করছে, তা বোঝার ক্ষমতা থাকা উচিত শিক্ষিত মেয়েদের। নারীদর্শনে অনিচ্ছুক বক্তাটি সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ভুক্ত, তিনি তাঁর পালনীয় নিয়ম মানছিলেন— এমন যুক্তি অচল। ব্যক্তিপরিসরে যে কেউ, যে কোনও নিয়ম মানতে পারে। কিন্তু জনপরিসরে মান্যতা পাবে দেশের সংবিধান, যা পুরুষ-নারীকে সমান মর্যাদা দেয়। কোনও ধর্মীয় অনুশাসন সাম্যের নীতিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। সাম্য-অসহিষ্ণু বক্তাকে পরিহার করাই কর্তব্য।