—প্রতীকী ছবি।
রাজনৈতিক পরিসরে ভাষার ব্যবহার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের আত্মশ্লাঘার শেষ নেই। তাঁদের কথায় ও কাজে নাকি সতত উচ্চাঙ্গের নৈতিকতা ও রুচিবোধ জাগ্রত। রাজনৈতিক কার্যকলাপে নৈতিকতার যে অগণন নমুনা দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের শাসনকালে বঙ্গীয় বামপন্থীরা দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গবাসী আরও অন্তত সাড়ে তিন দশক তার বহু স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে রাখবেন। কিন্তু মুখের কথায় বহু কাল ধরেই তাঁরা যে সব মণিমুক্তা বিতরণ করে এসেছেন, সেগুলিও আক্ষরিক অর্থেই অবিস্মরণীয়। গত শতকের মধ্যভাগে অতুল্য ঘোষ, কিংবা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ও ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে তাঁদের সচিত্র প্রচারবার্তাগুলি কেবল লজ্জাকর ছিল না, ছিল ভয়াবহ রকমের অশালীন। কালক্রমে, সমাজ-সংস্কৃতির চাপে, সেই ধরনের প্রচার কমেছে বটে, কিন্তু একটি বিষয়ে তাঁদের শিবিরে অসুস্থ কুরুচির ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। সেটি হল মহিলাদের সম্পর্কে অসম্মানজনক উক্তি, যার পরতে পরতে কুশিক্ষা এবং বিকৃত মানসিকতার দগদগে স্বাক্ষর। ছোটখাটো পার্টিরত্নদের কথা বাদ দেওয়া গেল, বিনয় কোঙার, অনিল বসু, আনিসুর রহমান প্রমুখ রথী মহারথীরা তাঁদের উৎকট সব কটূক্তির জন্য বারংবার নিন্দিত হয়েছেন, কেউ কেউ দলের অধীশ্বরদের কাছে মিঠে বা কড়া তিরস্কার শুনেছেন, কিন্তু ব্যাধি দূর হয়নি।
সম্প্রতি সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের শ্রীমুখের বাণীতেও এই ব্যাধির উপসর্গই প্রকট হয়ে উঠল। মহম্মদ সেলিম বাক্পটু হিসাবে পরিচিত, সেই পরিচিতি সম্ভবত তিনি নিজেও বিশেষ উপভোগ করেন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে রকমারি তির্যক উক্তি ও চটকদার রূপক সহযোগে প্রায়শই অতিমাত্রায় বাঙ্ময় হয়ে ওঠেন। সোমবার রাজ্যের ‘প্রভাবশালী’ নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়েও তিনি হয়তো আসর জমাতেই চেয়েছিলেন। অতএব ওই নেতার অবৈধ সম্পদের সঙ্গে বিদেশিনিদের সংযোগের প্রসঙ্গে তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হল প্রগাঢ় টীকাভাষ্য। তিনি জানালেন, শুদ্ধ ভাষায় ওই বিদেশিনিদের হয়তো ‘মডেল’ বলা হয়, কিন্তু তিনি তাঁদের বলবেন ‘বারবনিতা’। শুদ্ধ ভাষায় অরুচি কেন, সে প্রশ্ন থাকুক। মডেল এবং বারবনিতাকে একাকার করে দেওয়ার এই প্রবণতাটি যতটা প্রচলিত, ততটাই আপত্তিকর। আপত্তিকর কেবল কুরুচির পরিচায়ক বলে নয়, অশিক্ষার পরিচায়ক বলেও। কিন্তু থাকুক সেই প্রসঙ্গও। রাজ্য সম্পাদক নিশ্চয়ই বোঝাতে চেয়েছেন যে, অভিযুক্ত প্রভাবশালীরা কেবল দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, তাঁরা বিদেশি বারবনিতাদের নামে দুর্নীতির অর্থ সরিয়ে রাখেন। বলা বাহুল্য, এই বাড়তি কটাক্ষের কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না, পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগেই বিরোধী রাজনীতিক নিজেকে সীমিত রাখতে পারতেন। কিন্তু শ্রোতাদের হাততালি কুড়োনোর জন্যই হোক অথবা/এবং নিজস্ব রসবোধের তাড়নাতেই হোক, তাঁকে বারবনিতা আমদানি করতে হল।
এখানেই ব্যাধির দুর্লক্ষণ। পিতৃতন্ত্রের ব্যাধি। সেই তন্ত্র তার নিজস্ব নৈতিকতার ধারণাটিকে মেয়েদের উপর শাসন জারি রাখার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। এই অস্ত্র দু’দিকেই কাটে— তার এক দিকে সতীত্বের মহিমা, অন্য দিকে বারবনিতার কলঙ্ক। মহম্মদ সেলিম, হয়তো নিজের অজানতেই, এই পিতৃতন্ত্রের ঠুলিটি চোখে সেঁটে রেখেছেন। তিনি বলতেই পারেন যে, অনিল বসুদের সঙ্গে তাঁর তুলনা অন্যায়, কারণ তিনি কোনও নারীর অপমান করার জন্য বারবনিতা শব্দটিকে ব্যবহার করেননি। ঠিকই, কিন্তু ব্যাধির প্রকাশ আলাদা হলেও ব্যাধিটি একই। বস্তুত, স্বাভাবিক মনে করে এমন কথা বলেছেন বলেই এক অর্থে তাঁর মন্তব্যটি আরও বেশি উদ্বেগজনক। সে কেমন স্বভাব, যাকে অহেতুক বারবনিতার প্রসঙ্গ টেনে এনে রাজনীতির লড়াই লড়তে হয়? পিতৃতন্ত্রের এই গরল থেকে কি কমরেডদের চেতনার (এবং অবচেতনের) মুক্তি নেই?