ফাইল চিত্র।
ইতিহাস তবে পুনরাবৃত্ত হইল মায়ানমারে। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আউং সান সু চি-র ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি-র বিপুল জয় স্বীকার করে নাই সেনাবাহিনী, ক্ষমতা দখল হয় অভ্যুত্থানে, আগামী দুই দশক বন্দি থাকেন জননেত্রী। এক্ষণে তাহারই পুনরভিনয় ঘটিল। পাঁচ বৎসর সফল ভাবে সরকার চালাইবার পরে বিগত নভেম্বরে দ্বিতীয় বারের জন্য সু চি-র দলের হাতে দেশ শাসনের ভার অর্পণ করে মায়ানমারের জনতা। ফলাফল তৃপ্ত করে নাই সেনাকে, ২০১৫ অপেক্ষাও খারাপ ফল করে তাহাদের ‘প্রতিনিধি’ ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। নবগঠিত পার্লামেন্টের অধিবেশন বসিবার নির্ধারিত দিনেই বন্দি হইলেন সু চি, অবশিষ্ট নেতৃবৃন্দ, এমনকি প্রেসিডেন্ট ইয়িন ময়িন্ট-ও। অভ্যুত্থানের পর সেনা কর্তৃক বৎসরকালের জরুরি অবস্থা ঘোষিত হইয়াছে। বুঝা যাইতেছে, অতীত অগণতন্ত্রের করালগ্রাস হইতে অপসৃত হইতে পারে নাই মায়ানমার। অভিজ্ঞ জনে বলিবেন, এক বৎসরের সময়সীমাও প্রতিশ্রুতিমাত্র। তাহা কেবল এই অগণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত পাকা করিবার ভিত।
মায়ানমারের সেনাবাহিনীর সচরাচর নিন্দায় বিচলিত হইবার দুর্নাম নাই। ভূতপূর্ব সেনাতন্ত্রে তাহারা বারংবার আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করিয়াছে। শেষাবধি পাতা নড়িয়াছে, যখন বহির্বিশ্বের সহিত বিচ্ছিন্নতা রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব সঙ্কটের সৃষ্টি করিয়াছে। বিশ্বের সহিত যোগস্থাপনে যদিও রাষ্ট্রকল্যাণ সাধিত হয় নাই, হইয়াছে আখের গুছানো। জনমানসে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে অপরাপর দেশের সহিত মিত্রতা পাতাইয়াছিল সেনা-সরকার। সম্ভবত ভীত সেনাকর্তারা ভাবিয়াছেন যে, জনতার অভূতপূর্ব রায়ে বলীয়ান হইয়া এই বার সংবিধান পাল্টাইয়া ফেলিতে পারেন সু চি। ২০০৮ সালে সেনার তত্ত্বাবধানেই লিখিত ও বলবৎ হইয়াছিল এক নূতন সংবিধান, যেখানে গণতন্ত্রের অবকাশেও অবিসংবাদিত ক্ষমতা পাইয়াছিল তাহারা। এক্ষণে গণতান্ত্রিক সরকারের তদারকে সংবিধানে প্রস্তুত হইলে হয়তো সেনার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হইত যথাস্থানে— ব্যারাকে। আশার কথা একটিই। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সেনাশাসন কায়েম রাখা আর পূর্বের ন্যায় সহজ নহে। দুনিয়া পাল্টাইয়াছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটে সু চি-র বিতর্কিত ভূমিকা লইয়া আপত্তি থাকিলেও অভ্যুত্থানের নিন্দা করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নাই আন্তর্জাতিক মহল।
মায়ানমারের সেনার কার্যকলাপে ‘গভীর উদ্বেগ’ গোপন রাখে নাই নয়াদিল্লিও। তাহাদের সওয়াল গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে। স্মরণীয়— ভারত সেই বিরল দেশ, সেনাতন্ত্রের আমলেও যাহাদের মায়ানমারের সহিত সংযোগ ছিন্ন হয় নাই। সু চি জমানাতেও রোহিঙ্গা-কাঁটা ব্যতীত দুই দেশের সম্পর্ক আপাত ভাবে মধুর ছিল। বস্তুত, উত্তর-পূর্বের দীর্ঘ সীমান্ত বরাবর অবস্থিত এই প্রতিবেশীকে নয়াদিল্লির পর্যবেক্ষণ না করিলেই নহে, বিশেষত বেজিংয়ের ছায়া যেখানে ক্রমশ দীর্ঘতর হইতেছে। আর সমগ্র বিশ্বের পক্ষেই ইহা শিখিবার যে, বহু বৎসরের সংগ্রামের ফসল কী ভাবে তুড়িতে হাতছাড়া হইতে পারে। এত কিছু অর্জনের পরেও ফিরিতে হইতে পারে সূচনাবিন্দুতে। গণতন্ত্র অতি মূল্যবান, এবং সর্বার্থেই একটি অধিকার। ছলনা করিলে তাহার সহিত মিত্রতা মরীচিকায় পরিণত হওয়া অসম্ভব নহে।