ভারতীয় গণতন্ত্র সত্যই আক্রান্ত। ছবি: পিটিআই।
রাহুল গান্ধীকে আক্রমণের প্রধান নিশানা করে রাখলে বিজেপির লাভ না লোকসান, সেই তর্ক আপাতত থাকুক। কিন্তু এই কথাটি নিঃসংশয়ে বলা চলে যে, তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ জারি রাখার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় শাসক দল অতি তৎপর। এ দেশে মেয়েদের যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়, এ বিষয়ে ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার সময়ে কোনও কোনও মেয়ে তাঁর কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন— রাহুল গান্ধীর এমন একটি উক্তির সূত্র ধরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ শেষ পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে ওই উক্তির সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ দাবি করেছে। তাদের ‘যুক্তি’ হল, যে মেয়েরা হেনস্থার অভিযোগ করেছেন তাঁদের সন্ধান জেনে তাঁদের নিরাপত্তার বিধান করা দরকার! বিপন্ন মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়ার ভাবনায় রাজধানীর পুলিশ ও তাঁদের কর্তাদের বোধ করি রাতে ঘুম হচ্ছে না! নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটবার অন্য কারণ অবশ্য থাকতেই পারে। ‘ভারত জোড়ো’ অভিযানে বিচলিত হয়ে বা সরকারি অনাচার নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন তোলার কারণে ক্রুদ্ধ হয়েই কি শাসকরা প্রত্যাঘাত করতে চাইছেন এবং সেই কারণেই বিরোধী রাজনীতিকের ভদ্রাসনে পেয়াদা পাঠানো হচ্ছে?
বিরোধী রাজনীতিক হিসাবে রাহুল গান্ধীর সাফল্য বা ব্যর্থতার মাত্রা যা-ই হোক না কেন, একটি সত্য অনস্বীকার্য। শাসকের অন্যায় নীতি ও আচরণের প্রতিবাদে নিরন্তর সরব এবং সক্রিয় থাকার ব্যাপারে বিরোধী শিবিরে তিনি কার্যত অ-দ্বিতীয়। এই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই সম্প্রতি লন্ডনে একটি সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি ভারতে, বিশেষত ভারতীয় সংসদে গণতন্ত্রের বিপন্নতার কথা বলেছেন, সেই বিপন্নতার জন্য শাসকদের অ-গণতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী আচরণকে দায়ী করেছেন। তাঁর অভিযোগ, সংসদে বিরোধীরা কথা বলার সময় মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই অভিযোগ অসত্য হলে শাসকরা তথ্যপ্রমাণ সহকারে সে-কথা প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। তা তাঁরা করেননি, উপরন্তু ইতিমধ্যে সংসদের অধিবেশন সম্প্রচারের সময় টেলিভিশন নির্বাক হয়ে গিয়েছে! সবই নাকি ‘যান্ত্রিক গোলযোগ’! এমন বহুশ্রুত অজুহাতকেও নাহয় ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা’ মন্ত্রের নির্দেশে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু রাহুল গান্ধী বিদেশের মাটিতে বসে ভারতের অপমান করেছেন বলে বিজেপির নেতা মন্ত্রী সাংসদরা যে ভাবে শোরগোল বাধিয়েছেন এবং তাঁকে লোকসভা থেকে নিলম্বিত করার দাবি তুলে সংসদের অধিবেশন পণ্ড করছেন, তাতেই গণতন্ত্রের প্রকৃত অমর্যাদা।
বিদেশে গিয়ে স্বদেশের সম্পর্কে অপমানজনক কোনও কথা না-বলার রীতি চিরাচরিত। রাহুল গান্ধী, নরেন্দ্র মোদী কিংবা অন্য কোনও রাজনীতিকেরই সেই রীতি অমান্য করা সঙ্গত নয়। রাহুল গান্ধী তা অমান্য করেছেন কি না, সেই বিষয়ে রাজনৈতিক বা বৃহত্তর সামাজিক বিতর্ক চলতেই পারে, শাসক শিবিরের মুখপাত্ররাও তাতে যুক্তি এবং তথ্য সহকারে যোগ দিতে পারেন, সেটাই গণতন্ত্রের ধর্ম। তার জন্য ‘হা রে রে রে’ রবে ধুন্ধুমার বাধানোর কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, রাহুল গান্ধী তো ভারতের অমর্যাদা করেননি, এমনকি সামগ্রিক বা সাধারণ অর্থে ভারতীয় রাষ্ট্রেরও অপমান করেননি, তিনি বর্তমান শাসকদের কিছু আচরণের সমালোচনা করেছেন। সরকারের সমালোচনা এবং রাষ্ট্রের নিন্দা যে এক নয়, এই প্রাথমিক সত্যটিকে অস্বীকার করলেই গণতন্ত্রের বিপুল অমর্যাদা হয়। কেবল অমর্যাদা নয়, সরকার এবং রাষ্ট্রকে একাকার করে ফেললে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়, আক্রান্ত হয়। বস্তুত, সরকারের সমালোচনা বন্ধ করার তাড়নায় এবং বিরোধী স্বরকে বন্ধ করার কৌশল হিসাবে শাসক দলের লোকেরা যে কাণ্ড করছেন, সেটাই প্রমাণ করছে যে রাহুল গান্ধীর অভিযোগ ও উদ্বেগ অসত্য নয়। ভারতীয় গণতন্ত্র সত্যই আক্রান্ত। রক্ষকই ভক্ষক।