গত চার মাসে ভারতের মাটিতে আটটি চিতার মৃত্যু হয়েছে। —ফাইল চিত্র।
তেজস, সুরজ, উদয়। শব্দগুলি শুনে মনে হতে পারে, চন্দ্রযান-৩’এর সফল উৎক্ষেপণের পরে উৎসবে মেতে ওঠা ভারত বোধ হয় নতুন মহাকাশ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তা নয়। এরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের ‘প্রোজেক্ট চিতা’র অধীনে আফ্রিকা থেকে আসা সেই সব চিতা, যাদের মৃত্যু হয়েছে ভারতে, মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যানে। তথ্য বলছে, এই নিয়ে গত চার মাসে ভারতের মাটিতে আটটি চিতা মারা গেল— তার মধ্যে গত সপ্তাহে তিন দিনের ব্যবধানে দু’টি! ভারতে চিতা নিয়ে আসার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যে ভাবে ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল, নামকরণ থেকে শুরু করে তাদের জঙ্গলে ছাড়ার দিনক্ষণ হিসাবে যে ভাবে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনটি বেছে নেওয়া হয়েছিল, একের পর এক চিতার মৃত্যুতে সেই সবই এখন মনে হচ্ছে চূড়ান্ত আদিখ্যেতা; ‘অমৃত মহোৎসব’কালে মৃতের বিষাদ।
কিন্তু আসল প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর সরকারের ভাবমূর্তির নয়। আসল প্রশ্ন, কেন এ ভাবে পর পর চিতার মৃত্যু ঘটছে? গত মে মাসে স্ত্রী চিতা দক্ষের মৃত্যু হয়েছিল অন্য চিতার সঙ্গে মারামারির জেরে, পরে মারা যায় দু’টি চিতাশাবকও। জঙ্গলে পশুদের লড়াই তাদের জীবন ধারণেরই স্বাভাবিক অংশ, কিন্তু অন্যগুলির ক্ষেত্রে? সাশা নামের স্ত্রী চিতাটির মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষ কারণ দেখিয়েছিলেন কিডনির সমস্যা, উদয় নামের পুরুষ চিতাটির ক্ষেত্রে ‘কার্ডিয়ো-পালমোনারি ফেলিয়োর’। বলা হয়েছিল, এ সবই ‘ন্যাচারাল কজ়’ বা স্বাভাবিক কারণজনিত মৃত্যু। তেজসের ময়নাতদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, অন্য এক চিতার সঙ্গে লড়াইয়ের জেরে তার শরীরে একাধিক ক্ষত হয়, সে ভিতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ভুগছিল ‘ট্রমা’য়। কিন্তু এত শ্রম সময় পরিকল্পনা ও অর্থ ব্যয়ে ভিন্ন মহাদেশ থেকে যাদের ভারতে নিয়ে আসা হল, তাদের কিডনি, স্নায়ু, কার্ডিয়ো বা অন্য কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, কর্তৃপক্ষ তা জানবেন-বুঝবেন না? প্রতিটি চিতা যখন রেডিয়ো কলার পরানো, তখন চিতাদের মারামারির পর আহত চিতার তাৎক্ষণিক ও পরে নিয়ম করে চিকিৎসার ব্যবস্থা ও নজরদারি হবে না কেন?
এখন কথা উঠেছে রেডিয়ো কলার নিয়েও। বিদেশের চিতা বিশেষজ্ঞ বলছেন, সর্ব ক্ষণ রেডিয়ো কলার সেঁটে থাকায় চিতাদের শারীরিক অস্বস্তি তাদের অসুস্থতার একটা কারণ বা অনুঘটক হতে পারে। আফ্রিকার ‘বৃষ্টি’ আর ভারতীয় ‘বর্ষা’য় বিস্তর তফাত, ভেজা আবহাওয়া আর রেডিয়ো কলার মিলে ডেকে আনতে পারে চিতাদের অসুস্থতা, চামড়া ও অন্যান্য অঙ্গে ক্ষত-সংক্রমণ। সুরজ নামের চিতাটির মৃত্যুর পরে কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের বিবৃতিতে এক দিকে ‘রেডিয়ো কলার-তত্ত্ব’ নস্যাৎ করা হয়েছে, গাওয়া হয়েছে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র সাফাই, অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রদেশের মুখ্য বনরক্ষক (বন্যপ্রাণ) বলছেন জীবিত চিতাগুলির রেডিয়ো কলার খোলার প্রস্তুতি ও তাদের ‘মনিটরিং’-এর কথা। দু’পক্ষের যোগাযোগের ফাঁকফোকর প্রকট হচ্ছে, সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের মুখরক্ষার মরিয়া চেষ্টাও। এখন জানা যাচ্ছে, তেজস ও সুরজের ক্ষেত্রে যেমন ফুটে উঠেছিল, প্রায় তেমনই শারীরিক সমস্যার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে গৌরব ও শৌর্য নামের জীবিত দুই চিতার ক্ষেত্রেও। অবিলম্বে এদের চিকিৎসা ও যত্ন দরকার, আর কোনও চিতার মৃত্যুসংবাদ যেন শুনতে না হয়।