—প্রতীকী চিত্র।
ছোট মানে ছোট নয়, জানা নিশ্চয়। সম্প্রতি একটি সংবাদ সেই জানা কথা আবার মনে করিয়ে দিতে পারে। একটি প্রাথমিক স্কুলের খবর— সেখানে আট বছর ধরে কোনও পানীয় জল নেই। খবরটি কেবল পরিসরে ছোট নয়, সংবাদের পাতায় তার আকারও ছোট, নানা রাজনৈতিক কলহ তরজা বিক্ষোভ আন্দোলন প্রচার প্রসারের মধ্যে এক পাশে তা একটুখানি জায়গা পেয়েছে। তাও পেয়েছে এই জন্যই যে, হাই কোর্টে এই মামলা যাওয়ায় আদালত একটি রায় দিয়েছে, এবং স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে, দুই সপ্তাহের মধ্যে পড়ুয়াদের খাওয়ার জলের ব্যবস্থা করার। সংবাদজগতেও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরের এই স্কুল আট বছরের মধ্যে জায়গা করে উঠতে পারেনি, এতই সে ‘ছোট’। এখানে এসে একটু নিজেদের পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে ভাবা দরকার, খবরটির পুরো অর্থই বা কী, এবং তার এই মামলা-চক্রে শেষ পর্যন্ত খবর হয়ে উঠতে পারার ঘটনাই বা আসলে কী বলে। নিজেদের ‘পিছিয়ে নিয়ে গেলে’ই হয়তো একটা প্রেক্ষিতবোধ জন্মাবে, দূরত্ব বাড়ার বদলে দূরত্ব কমবে, নৈকট্যের বোধ তৈরি হবে।
প্রাথমিক স্কুলে জল না থাকলে পড়ুয়াদের কী অবস্থা হতে পারে, সেটা কল্পনা করা শক্ত নয়, কিন্তু সেই কল্পনার ক্ষমতা বা ইচ্ছা এই সমাজের কোনও স্তরেই নেই। বড় প্রশাসনের কথা বাদই দেওয়া গেল, স্কুল কর্তৃপক্ষও যে শিশুদের মুখ চেয়ে এইটুকু করার কথা ভাবতে পারেন না, তা বলে দেয় আজকের দিনের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামগ্রিক ভাবে সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঔদাসীন্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কোন স্তরে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে মিড-ডে মিল’এর ব্যবস্থাও যে কর্তৃপক্ষকে চালাতে হয়েছে, তাঁরা কী ভাবে এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন, প্রশ্ন বটে। সন্দেহও বটে। এই পরিস্থিতিতে মিড-ডে মিল বন্দোবস্ত অপ্রতিহত ও যথেষ্ট আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ। পুকুরের জল দিয়ে কাজ চালানো হয়েছে, অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের উত্তর শোনা গিয়েছে, পুকুরের জল নয়, দূরের কল থেকে জল আনা হয়েছে। কিন্তু জয়নগর যে-হেতু জনস্থানবহির্ভূত কোনও এলাকা নয়, এত কিছুর মধ্যে জলের কল বসানো কেন এত দুরূহ চ্যালেঞ্জ হয়ে ছিল এত দিন, কর্তৃপক্ষের কাছে সে বিষয়ে কোনও উত্তর নেই। থাকার কথাও নয়।
রাজ্যের শিক্ষাজগৎ কেমন ভাবে চলছে, জয়নগরের বিদ্যালয়টির জল-সমস্যাকে তার প্রতীক ধরা যেতে পারে। জেলার নানা প্রান্তে সরকারি স্কুলগুলি কেবল বন্ধ হচ্ছে এবং ধুঁকছে বললে কম বলা হয়, যেগুলি আপাত ভাবে ‘চলছে’, তাদের চলার মধ্যেও পদে পদে অস্বাভাবিকতা ও সঙ্কটময়তা। কোথাও শিক্ষক নেই, কোথাও শ্রেণিকক্ষ বা পরিকাঠামো নেই, কোথাও হয়তো পড়ুয়ারাই নেই। কোভিড-উত্তরকালে পরিস্থিতি যেমন দাঁড়িয়েছে, তাতে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলমুখো করাই এক দুঃসাধ্য কাজ। এর মধ্যে যদি মিশে যায় সরকারি ও নাগরিক ঔদাসীন্য, তা হলে স্কুলছবি পাল্টানোরও আশা থাকে না। অথচ বুঝতে হবে যে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যাহত হলে যে সামাজিক ক্ষতি হতে চলেছে, তা সমগ্র রাজ্যের ভবিষ্যৎকেই অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। এই মৌলিক সত্যটি বোঝার দায়, এবং শিক্ষাপরিবেশকে সুস্থ ভাবে চলমান রাখার দায় প্রথমত ও প্রধানত প্রশাসনের। কিন্তু দ্বিতীয়ত এবং শেষত, বৃহত্তর সমাজেরও।