নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। ফাইল চিত্র।
গোড়াতেই একটি কথা স্পষ্ট করে বলে নেওয়া দরকার। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য অতি বড় তিরস্কার বা সমালোচনা শুনেও কিছুমাত্র লজ্জিত বা বিচলিত হবেন এবং আত্মসংশোধনের সামান্যতম বাসনাও তাঁর অন্তরে জাগ্রত হবে, এমন সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। এ-যাবৎ তাঁর কথা এবং কাজের যে প্রদর্শনী দেশের লোক বিস্ফারিতনয়নে দেখেছেন, তাতে তাঁর লজ্জাবোধের বহর জানতে কারও বাকি নেই। সমস্যা হয়তো বা একেবারে উৎসভূমিতে— স্বাভাবিক ভদ্রতা ও সৌজন্যের যে মৌলিক ধারণা তথা বনিয়াদি শিক্ষাদীক্ষা সভ্যসমাজে জীবনচর্যার ন্যূনতম শর্ত হিসাবে গণ্য হয়, তা পূরণ করতে ব্যর্থ হলেই তো সামাজিক মানুষ লজ্জা বোধ করেন; সেই ধারণার বিকাশ না ঘটলে লজ্জাবোধও অস্ফুট থেকে যায়। তথাপি, নিষ্ফল জেনেও, শ্রীযুক্ত বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর আচরণের কঠোরতম নিন্দা একটি অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ তিনি পদাধিকারবলে বিশ্বভারতীর উপাচার্য। কারও ব্যক্তিগত লজ্জাবোধ বা তার অভাব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার হয় না, কিন্তু তিনি যদি রাজ্যের তথা দেশের এক ঐতিহাসিক এবং অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের আসনে উপবিষ্ট হন, তা হলে নীরবতা অন্যায়কে সহ্য করার শামিল হয়ে দাঁড়ায়।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের পারিবারিক আবাসের প্রশ্নে উপাচার্যের আচরণ বাস্তবিকই অসহনীয় মাত্রা অর্জন করেছে। আইনি অধিকার সম্পর্কে বিতর্ক থাকলে তার নিরসনের সুষ্ঠু ও সুচারু উপায় আছে, অধ্যাপক সেন নিজে সে-কথা আগেও জানিয়েছেন, এখনও বারংবার বলেছেন। কিন্তু দু’কাঠা জমির দখল নিয়ে যে কাণ্ড বিদ্যুৎবাবু শুরু করেছেন এবং আক্ষরিক অর্থে দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে গভীরতম সংশয় হয় যে, জমি-প্রশ্নের মীমাংসা নয়, জল ঘোলা করা এবং সেই ঘোলা জলে অধ্যাপক সেনের সম্মানহানি ঘটানোই তাঁর প্রকৃত লক্ষ্য। যে ভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে প্রবীণ অধ্যাপকের কাছে ‘উকিলের চিঠি’ যাচ্ছে, যে ভাবে জমি ফেরত না দিলে ‘বিড়ম্বনা হতে পারে’ বলে জানানো হচ্ছে, অশোভন আচরণ সেখানেই সীমিত থাকেনি, প্রাতিষ্ঠানিক সভায় কথা বলতে গিয়ে উপাচার্য মহাশয় ক্রমাগত নানাবিধ বঙ্কিম উক্তি ছুড়ে দিচ্ছেন, এমনকি অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার ‘আসলে নোবেল পুরস্কার নয়’ বলে হাস্যকর ও উদ্ভট অভিযোগ তুলছেন। এই সমস্ত কীর্তিকেই অপ্রকৃতিস্থের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পদটিকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না, তার গুরুত্ব সম্পর্কে পদাধিকারীর কিছুমাত্র ধারণা বা বোধ না থাকলেও।
উপাচার্য মহাশয়ের হয়তো জানা নেই, অন্যায় কটূক্তি ছুড়ে বা অনর্থক বিব্রত করে মানীর মান হরণ করা যায় না, তাতে কেবল নিজের অপমান হয়। এবং অপমান হয় নিজের প্রতিষ্ঠানের, নিজের সমাজের, নিজের দেশের। কালস্রোতে ব্যক্তি— অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী অবধি সমস্ত স্তরের ব্যক্তি— এক দিন অতীত হয়ে যাবেন, কিন্তু থেকে যাবে এই লজ্জার ইতিবৃত্ত। লজ্জা বিশ্বভারতীর, লজ্জা পশ্চিমবঙ্গের, লজ্জা ভারতের। বিশ্ববন্দিত এক জন প্রবীণ শিক্ষাব্রতীকে অনর্থক অপমান করার লজ্জা। এই অশোভন আচরণ হয়তো দিল্লীশ্বরদের প্রিয়পাত্র হওয়ার কৌশল, তাঁদের কঠোর ও দ্বিধাহীন সমালোচনায় মুখর অমর্ত্য সেনকে বিব্রত করলে হয়তো উন্নততর কেরিয়ার নির্মাণের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে। মহান ভারতের অমৃত কাল-এ হয়তো এমনটাই ঘটবার কথা। কিন্তু দেশের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা নিশ্চয়ই এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এমন লজ্জাকর আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানাবেন। লজ্জাবোধ কখনও কখনও অত্যন্ত জরুরি।