Indian Economy

দুই ভারত

ভারতের পরিসংখ্যান বলছে, উচ্চ-মূল্যের পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে চড়া হারে বৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির হার রীতিমতো কম।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৩ ০৬:৩৪
Share:

—প্রতীকী ছবি।

একই দেশের পরিসরে কি বাস করছে দুই ভারত? বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করলে বলতে হয়, সত্যিই তাই। তুলনায় ছোট একটি অংশের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছে প্রবল হারে— এমন হারে যে, গোটা অর্থব্যবস্থার সামগ্রিক বৃদ্ধির হারও তাতে রীতিমতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে— আর অন্য দিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনও বাস করছেন ‘আর্থিক মন্দা’য়। অধ্যাপক বসু বেকারত্বের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এই বৈষম্যের দিকে নির্দেশ করেছেন। গত অর্থবর্ষে ভারতের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ২৩.২ শতাংশ। যে দেশগুলি ভারতের সঙ্গে তুলনীয় অবস্থায় রয়েছে, সেগুলির মধ্যে আছে ইয়েমেন, ইরান, লেবানন, সিরিয়া ইত্যাদি— প্রতিটি দেশই রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতায় দীর্ণ, বিধ্বস্ত। ভারতের মতো স্থিতিশীল একটি দেশে বেকারত্ব যদি এমন ভয়ানক হয়, তা হলে তার কাঠামোগত কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। ভারতে কাজের বাজারের ছবিটি যে গভীর উদ্বেগের, তার অন্য প্রমাণ রয়েছে জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার কাজের চাহিদায়। অতিমারির আগের দু’বছরে, অর্থাৎ ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কর্মসংস্থান যোজনায় কাজ করেছিলেন যথাক্রমে ৭.৭৭ কোটি ও ৭.৮৮ কোটি মানুষ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৮.৭৬ কোটিতে। এর দু’টি ব্যাখ্যা সম্ভব— এক, অতিমারিতে যত কাজ নষ্ট হয়েছিল, তার একটা অংশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি; এবং দুই, গ্রামীণ ক্ষেত্রে বর্তমানে মজুরির হার এমনই কম যে, মানুষকে অন্নসংস্থান করার জন্য অতিরিক্ত কাজের সন্ধান করতে হচ্ছে। কোনও ব্যাখ্যাই সুষম আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না।

Advertisement

এই পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটেছে গ্রামীণ চাহিদার ক্ষেত্রে। বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য বিপণন সংস্থা জানাচ্ছে যে, গ্রামীণ বাজারে বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধির হার অতি শ্লথ। এ দিকে, কৃষিক্ষেত্রে এ বছর ভাল বৃদ্ধি ঘটেছে। ফলে, এ ক্ষেত্রেও দু’টি সম্ভাবনা— এক, বহু লোক অ-কৃষি ক্ষেত্রে কাজ না পেয়ে কৃষিতে কাজ করছেন, ফলে সামগ্রিক বৃদ্ধি ঘটলেও মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি তেমন ঘটেনি; এবং দুই, অ-কৃষি ক্ষেত্রে কাজের জোগান এবং মজুরি, দুই-ই তলানিতে; অথবা দু’টি ঘটনাই এক সঙ্গে ঘটছে। শহরাঞ্চলেও ছবিটি একই রকম বিবর্ণ। শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি অতি শ্লথ। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাসে শহরাঞ্চলের শ্রমশক্তির ৩৪ শতাংশ নিযুক্ত ছিল শিল্পক্ষেত্রে; ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে সেই অনুপাতটি দাঁড়িয়েছে ৩২.৯ শতাংশে। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে থেকে জানা যাচ্ছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্তির অনুপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে ভারতের শ্রমশক্তি ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হচ্ছে।

আর্থিক বৃদ্ধি যদি অসম হয়, ভোগের বণ্টনে তার প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য। ভারতের পরিসংখ্যান বলছে, উচ্চ-মূল্যের পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে চড়া হারে বৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির হার রীতিমতো কম। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভোগব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২.৫ শতাংশ। পেট্রোলিয়াম, মূল্যবান পাথর ও গয়না ছাড়া অন্য আমদানির পরিমাণ বেড়েছে মাত্র ২.২ শতাংশ, যা সামগ্রিক চাহিদার শ্লথতার প্রমাণ। ঘটনাটি স্পষ্ট— আয় ও সম্পদের সিঁড়িতে একেবারে উপরের দিকে থাকা জনগোষ্ঠীর ভোগব্যয় যখন বেড়েছে, তখন মধ্যবিত্ত এবং বিশেষত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ভোগব্যয় ধাক্কা খেয়েছে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, আর্থিক সিঁড়িতে নীচের দিকে থাকা মানুষের আয়ের সিংহভাগ খরচ হয় ভোগব্যয়েই। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় সরকার যে পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ আর্থিক পুনরুদ্ধার বলে দাবি করতে, এবং তাতে বিশ্বগুরুর কৃতিত্ব প্রমাণ করতে ব্যস্ত, প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের সিংহভাগ মানুষ সেই সমৃদ্ধির বাইরে থেকে গিয়েছেন। তাঁরা দ্বিতীয়, দরিদ্রতর ভারতের নাগরিক।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement