—প্রতীকী ছবি।
কিছু কিছু সংবাদ বলে দেয়, সুদিন চলছে, না দুর্দিন। রাজ্যে প্রসূতিমৃত্যু বাড়ার সংবাদটি সেই রকম। ২০২২-২৩ সালে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১১১২ জন মহিলা। ২০২৩-২৪ সালে আরও পঞ্চাশ যোগ হয়েছে মৃতের তালিকায় (১১৬২)। যদিও ২০২১-২২ সালের তুলনায় (১২৩৪) সংখ্যাটি কম, কিন্তু কোভিড বিপর্যয়ের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির তুলনা করা চলে না। হাসপাতাল, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতেও কেন প্রসূতিমৃত্যু কমছে না, বরং আরও বেশি মেয়ের কাছে সন্তানের জন্মদান প্রাণের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সে প্রশ্নটা বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রশ্নটি কেবল স্বাস্থ্য বা নারী অধিকারের নয়, উন্নয়নেরও। কারণ উন্নয়নের অন্যতম সূচক প্রসূতিমৃত্যুর হার। সারা ভারতে যখন প্রসূতিমৃত্যুর হার কমছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ কেন লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। সংবাদে যে কারণগুলি সামনে এসেছে, তাতে তিনটি সম্ভাব্য দিক প্রকাশ পাচ্ছে— অনুন্নয়ন, চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা, এবং ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে অসতর্কতা। স্বাস্থ্য, বিশেষত মা ও শিশুর স্বাস্থ্য কেবল উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে সুরক্ষিত করা যায় না। তার জন্য দরকার পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সার্বিক নিরাপত্তা। পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহ, এবং নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা মাত্রাছাড়া। কোভিডের পরে এই সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। অথচ, রাজ্য সরকার তাকে উপেক্ষা করে কেবলই কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো অনুদান প্রকল্পের সাফল্যের প্রচার করে চলেছে। প্রাণ হারাচ্ছে কিশোরীরা। গত এক বছরে যত প্রসূতিমৃত্যু ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে, তার চার জনের এক জনই কিশোরী— এই তথ্য গোটা রাজ্যের সরকার এবং অসরকারি সংগঠনগুলির কাছে এক বিপুল ব্যর্থতার প্রমাণ বহন করে আনে।
চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতার দিকটি সর্বজনবিদিত এবং বহু-আলোচিত। পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসাব্যবস্থা এখনও কলকাতা-সর্বস্ব। বহু ব্যয়ে জেলা হাসপাতালগুলিকে মেডিক্যাল কলেজে পরিণত করা হয়েছে, কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে শূন্য। কেন একটি সুরক্ষিত সিজ়ারের দায়িত্ব একটা মেডিক্যাল কলেজ নিতে পারে না, কয়েকশো কিলোমিটার দূরে প্রসূতিকে পাঠায়, সে প্রশ্ন এর আগেও বহু বার উঠেছে। শূন্য প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই মেলেনি। আধিকারিক ও হাসপাতাল কর্তারা খতিয়ে দেখে ব্যক্তি অথবা ব্যবস্থার কী কী গলদ চিহ্নিত করলেন, তার প্রতিকারে কী ব্যবস্থা করলেন, কাকে শাস্তি দিলেন, তার কিছুই তাঁরা প্রকাশ করেন না। প্রতিটি মৃত্যুর পর, অথবা মৃত্যুর পরিসংখ্যান প্রকাশের পর, তাঁরা বাঁধা বুলি আওড়ে যান। একটি জেলার ব্লক হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অবধি কোথাও যদি নিরাপদে প্রসব করানোর দক্ষতা বা পরিকাঠামো না থাকে, তা হলে জেলায় সরকারি চিকিৎসার ব্যয়ভার করদাতার উপরে চাপানো কেন?
প্রসূতিমৃত্যু কমানোর যে নীতি ভারত গ্রহণ করেছিল, তা হল বাড়িতে প্রসব না করিয়ে হাসপাতালে প্রসব। এর ফলে প্রসূতিমৃত্যুর হার আগের চাইতে অবশ্যই কমেছে, কিন্তু এখন ক্রমশ প্রকট হচ্ছে হাসপাতালের দুর্বলতাগুলি। যদি অপ্রয়োজনীয় সিজ়ারিয়ান সেকশন হয়, সে দায় হাসপাতালের। যদি অস্ত্রোপচারের পরে প্রসূতির অবস্থার উপর নিয়মিত নজরদারি না হয়, ভিতরে রক্তপাত হয়ে সে নীরবে মারা যায়, আরও নানা জটিলতা দেখা দিলে যদি সময়মতো তার মোকাবিলা না করা হয়, তা হলে রোগীকে জীবন দিয়ে তার খেসারত দিতে হয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারি হাসপাতালে ওষুধের মান নিয়ে উদ্বেগ— বেশ কিছু প্রসূতি কোনও নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই মারা যাওয়ায় এই প্রশ্ন তুলছেন চিকিৎসকেরাই। এ ক্ষেত্রেও গত কয়েক মাসে তদন্তের আশ্বাস ছাড়া কিছু মেলেনি। বিলম্ব যেখানে মৃত্যুর কারণ, সেখানে টালবাহানা কত বড় অপরাধ, তা মাতৃহীন নবজাতকের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে পারে দেশ।