Communal harmony

অন্তঃসলিলা

প্রতিবেশী প্রতিবেশীর পাশে থাকিবে, এই চিরাচরিত রীতিকে অস্বীকার করিয়া এবং লঙ্ঘন করিয়া বিদ্বেষের কারবারিরা যখন সমাজে বিরোধ বাধাইয়া তোলে

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২১ ০৬:১৭
Share:

কাশ্মীর উপত্যকার বাসিন্দা পণ্ডিত মাখনলালের মৃত্যু হইলে তাঁহার প্রতিবেশীরা যখন অন্ত্যেষ্টির যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেন তখন তাঁহারা সম্ভবত ভাবেন নাই যে, তাঁহাদের এই কাজটির কথা সংবাদ হিসাবে প্রচারিত হইবে। মাখনলাল স্বভূমিতে একা থাকিতেন। তাঁহার আত্মীয়স্বজন অন্যত্র বাসা বাঁধিয়াছেন, যেমন বাসা বাঁধিয়াছেন তিন দশক আগে উপত্যকা ছাড়িতে বাধ্য হওয়া অগণন কাশ্মীরি পণ্ডিত। মাখনলাল ভিটা ছাড়েন নাই। কাশ্মীরে জীবন কাটাইয়া তিনি সেখানেই বিদায় লইয়াছেন। প্রতিবেশীরা ধর্মে মুসলমান। কিন্তু জীবনেও যেমন, জীবনাবসানেও তেমনই তাঁহারা মাখনলালকে প্রতিবেশী হিসাবেই দেখিয়াছেন। যে হেতু তাঁহার কাছে ‘নিজের’ কেহ ছিল না, সুতরাং তাঁহারাই শেষকৃত্যের ব্যবস্থাপনা করিয়াছেন। বুঝিতে অসুবিধা হয় না যে, সুখে দুঃখে মানুষ মানুষের পাশে থাকিবে, এই স্বাভাবিক জীবনধর্মই তাঁহাদের চালনা করিয়াছে, নিতান্ত স্বাভাবিক ভাবেই।

Advertisement

প্রতিবেশী প্রতিবেশীর পাশে থাকিবে, এই চিরাচরিত রীতিকে অস্বীকার করিয়া এবং লঙ্ঘন করিয়া বিদ্বেষের কারবারিরা যখন সমাজে বিরোধ বাধাইয়া তোলে, সেই বিদ্বেষের তাড়নায় মানুষ তাঁহার জন্মজন্মান্তরের বাসভূমি ছাড়িয়া যাইতে বাধ্য হন, তখন স্বাভাবিক মানবধর্মকেও ব্যতিক্রমী মহানুভবতা বলিয়া মনে হয়। ১৯৯০ সালে ও তাহার পরে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকা ছাড়িয়া পরবাসী হইবার পিছনে যে বিদ্বেষের রাজনীতি তাহার দানবিক মূর্তিতে সক্রিয় হইয়াছিল, যে কোনও ভাবে কাশ্মীরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর রাষ্ট্রচালকরা যে রাজনীতির সওয়ার হইয়াছিলেন, কাশ্মীর নামক ভূস্বর্গে তাহার ভয়াবহ বিষক্রিয়ার পরবর্তী ইতিহাস আজ আর নূতন করিয়া বলিবার কোনও প্রয়োজন নাই। হিন্দুত্ববাদী শাসকরা সেই ইতিহাসকে যে নূতন অন্ধকারে ঠেলিয়া দিয়াছেন তাহাও ভুবনবিদিত।

কিন্তু মাখনলালের কাহিনি দেখাইয়া দেয়, স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব দুর্মর। শত অপুষ্টি, অযত্ন এবং অত্যাচার সত্ত্বেও যেমন মাঠেঘাটে গৃহস্থের অঙ্গনে নানান দেশজ লতাগুল্ম জন্মায়, তাহাতে ফুলও ফোটে, তেমনই সমাজজীবনের নিজস্ব আশ্রয়ে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার ধারাটি চলিতে থাকে। বস্তুত, এই ধারাই প্রধান এবং প্রবল, তাহা যদি না হইত, বিদ্বেষের বিষই যদি সমাজের মনকে অধিকার করিয়া ফেলিত, তাহা হইলে সমাজ বাঁচিত না। ইহা নিছক কাণ্ডজ্ঞানের বিচার। কাশ্মীর হইতে কন্যাকুমারী, কেরল হইতে পশ্চিমবঙ্গ— সর্বত্র তাহার ভরসাই এই দেশকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে, আজানে আর শাঁখের সুরে এবং— সমস্ত ধর্মীয় অনুষঙ্গের বাহিরেও— আটপৌরে জীবনের কাণ্ডজ্ঞানই আমাদের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। কবচকুণ্ডল কাড়িয়া লইবার, ভুলাইয়া লইবার চক্রান্ত চলিতেছে নিরন্তর। ভয়ঙ্কর চক্রান্ত। তাহার সম্পর্কে সতত সজাগ থাকা অত্যন্ত জরুরি, সর্বশক্তিতে তাহাকে প্রতিহত করিবার লড়াইয়ে এক মুহূর্তও ক্ষান্তি দিবার উপায় নাই। সেই লড়াইয়ের প্রথম এবং প্রধান প্রকরণ— মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক শক্তিতে আমাদের প্রত্যয়। তাহার শিকড় রহিয়াছে সামাজিক মানুষের আন্তরিক আস্থায়। এই আস্থার কারণেই মাখনলাল উপত্যকা ছাড়েন নাই। তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখিয়াছেন। উপত্যকা তাঁহার বিশ্বাস এবং আস্থার মর্যাদা রাখিয়াছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement