Alapan Bandyopadhyay

বিপন্ন বিশ্বাস

পশ্চিমবঙ্গের সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যসচিবকে কেন্দ্র করিয়া যাহা ঘটিয়া চলিয়াছে তাহাতে আশঙ্কা হয়, অস্বাভাবিকই কি অতঃপর স্বাভাবিক হইবে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২১ ০৪:৫৫
Share:

ফাইল চিত্র।

ভারতীয় সংবিধান দেশের শাসনতন্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্র বলিলেও তাহার বাস্তব প্রয়োগে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে গুরুত্ব তথা মর্যাদার তারতম্য যে বিপুল, তাহা অনস্বীকার্য। কিন্তু, স্বাধীন ভারতে অনেক সময়েই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোটের উপর সুষ্ঠু ভাবে কাজ করিয়াছে। এমনকি, কোনও কোনও বিষয়ে যখন কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ প্রবল, তখনও অন্য বিষয়ে দুই তরফের সমন্বয় ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকিয়াছে। আমলাতন্ত্র নামে পরিচিত প্রশাসনিক কাঠামোটি ইহার একটি নজির। এই কাঠামোয় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা অবশ্যই রাজ্যের তুলনায় বেশি। বিশেষত, আইএএস আধিকারিকদের নিয়োগ হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রেই কেন্দ্র এবং রাজ্যের ভূমিকা কার্যত বড় তরফ ও ছোট তরফ হিসাবেই নির্দিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু সেই উচ্চাবচতাকে মানিয়া লইয়াই সামগ্রিক বিচারে ব্যবস্থাটি স্বচ্ছন্দে চলিয়া আসিতেছে। বিভিন্ন সময়েই বিভিন্ন প্রশ্নে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়াছে বটে, কখনও কখনও তাহা সংঘাতের রূপও লইয়াছে— ছয় বৎসর আগে দিল্লি প্রশাসনের কার্যনির্বাহী মুখ্যসচিবের নিয়োগ লইয়া রাজ্য প্রশাসনের সহিত কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র বিবাদের কাহিনি মনে পড়িতে পারে। কিন্তু, সেগুলি সচরাচর অস্বাভাবিক এবং ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বলিয়াই ধরিয়া লওয়া হইয়াছে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যসচিবকে কেন্দ্র করিয়া যাহা ঘটিয়া চলিয়াছে তাহাতে আশঙ্কা হয়, অস্বাভাবিকই কি অতঃপর স্বাভাবিক হইবে? ব্যতিক্রম পর্যবসিত হইবে নিয়মে? এই বিবাদের পরিপ্রেক্ষিত এবং পরম্পরা ইতিমধ্যে বহুচর্চিত, তাহার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু গত কয়েক দিনের ঘটনাক্রম মন্থন করিয়া যে গভীর উদ্বেগ উঠিয়া আসিতেছে, তাহার গুরুত্ব এই বিশেষ উপলক্ষের সীমায় সীমিত নহে। কেন্দ্রীয় সরকার যে ‘কারণ’ দেখাইয়া যে ভাষায় যে কৈফিয়ত চাহিতেছে এবং যে ধরনের ‘প্রত্যাঘাত’-এর তোড়জোড় চালাইতেছে, তাহার পরতে পরতে প্রশাসনিক কাঠামোকে ক্ষুদ্র এবং সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতির প্রকরণ হিসাবে অপব্যবহার করিবার প্রয়াস অতিমাত্রায় প্রকট। রাজ্য সরকারের সহিত মতভেদ ঘটিতেই পারে, এমনকি তাহাতে ব্যক্তিগত বিরাগ বা বিদ্বেষ ছায়া ফেলিলেও বিস্মিত হইবার কিছু নাই— সরকারি কাজে ব্যক্তিগত আবেগকে জড়াইয়া ফেলা অনুচিত হইলেও বিরল নহে। কিন্তু মতবিরোধকে এমন মহাযুদ্ধের রূপ দিতে হইবে? দলীয় রাজনীতির আবর্ত হইতে প্রতিহিংসার বিষবাষ্প আসিয়া পড়িবে রাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্রের অন্দরমহলেও? কেন্দ্রের উচ্চপদস্থ আমলারা অবধি শঙ্কিত বোধ করিবেন?

সুষ্ঠু প্রশাসনের একটি অত্যাবশ্যক এবং অপরিহার্য শর্তের নাম: বিশ্বাস। স্বাভাবিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের রীতিতে বিশ্বাস। এক দিকে বিভিন্ন রাজ্যের ও কেন্দ্রের বিভিন্ন স্তরের আধিকারিকদের পারস্পরিক সমন্বয়, এবং অন্য দিকে, ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের সহিত তাঁহাদের সহযোগিতার একটি স্বাভাবিক রীতি যদি বহাল থাকে, তাহা হইলে নানা ধরনের সমস্যা ও মতবিরোধের সুষ্ঠু মীমাংসার পথে প্রশাসন সচল থাকিতে পারে। কিন্তু সেই বুনিয়াদি আস্থা যদি ভাঙিয়া যায়, আধিকারিকদের যদি প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাবোধের অভাবে ভুগিতে হয়, ভাবিতে হয়— ক্ষমতার কোন সিংহাসনের বিরাগভাজন হইলে প্রতিহিংসার কোন আঘাত আসিয়া পড়িবে; ক্ষমতাধরদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়িয়া আমলারা যদি বিব্রত, বিপর্যস্ত, লাঞ্ছিত হইতে থাকেন— তবে গণতান্ত্রিক প্রশাসনের কাঠামো সম্পূর্ণ বিপন্ন হইয়া পড়ে। এই গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি বুঝিবার সাধ্য নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার পারিষদবর্গের আদৌ আছে, এমন ভরসা কম। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যবস্থাটির প্রধান রক্ষকরাই যদি তাহার ভক্ষক হইয়া উঠেন, তবে রক্ষকদের পরিণতিও সুখকর হইবে কি?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement