প্রতীকী ছবি।
জল ঘুলাইয়া মাছ ধরা রাজনীতির পুরাতন কৌশল। কিন্তু কোভিড টিকার জোগানের প্রশ্নেও তাহার প্রয়োগ হইতে পারে, দেশবাসী বোধ হয় এতটা ভাবিতে পারেন নাই। কেন্দ্রীয় সরকার ভারতে কোভিড টিকা প্রস্তুতকারক দুই প্রধান সংস্থাকে টিকার দাম কমাইতে পরামর্শ দিয়াছে— এই সংবাদ সরকারের নীতিগত অবস্থানে অস্বচ্ছতার দিকেই নির্দেশ করিতেছে। জনসাধারণকে টিকা দিয়া সুরক্ষিত করিবার দায় সরকারের। তাহা সকলকে বিনামূল্যে দেওয়া হইবে, অথবা দামে ইতরবিশেষ হইবে, হইলে কাহার জন্য কত দাম নির্দিষ্ট হইবে— এই সকল সিদ্ধান্ত সরকারকেই করিতে হইবে। সেই অনুসারে টিকা জোগান দিবার দায়িত্বও সরকারকেই বহন করিতে হইবে। টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা সেই আর্থিক দায় লইবে কেন? তাহাদের টিকা প্রস্তুত করিবার খরচ কত, সেই অনুসারে দাম কত হইবে, তাহা বহু পূর্বেই সরকারকে জানাইয়াছে। আজ জনস্বাস্থ্যের দায় বাণিজ্যিক সংস্থার উপর চাপাইতে চাহে সরকার, ইহা বড়ই আশ্চর্য কথা। বিশ্বে ইহার দৃষ্টান্ত বিরল। প্রায় সকল দেশেই বিভিন্ন টিকা উৎপাদক সংস্থা নানা প্রকার দামে টিকা সরবরাহ করিতেছে। দেশের সরকার তাহা কিনিয়া নির্দিষ্ট মূল্যে (বহু দেশে বিনা মূল্যে) তাহা বিতরণ করিতেছে। কেন্দ্র আপন সুবিধা অনুযায়ী দেশি বা বিদেশি সংস্থাকে টিকার বরাত দিতে পারে, কাহারও দাম অধিক মনে করিলে তাহার টিকা না কিনিতে পারে। কিন্তু টিকার দাম নির্ধারণ করিবার দায় বাণিজ্যিক সংস্থার উপরে চাপাইতে পারে না। রাজ্য সরকার কত দামে টিকা পাইবে, বেসরকারি হাসপাতালে তাহা কত দামে মিলিবে, তাহার নির্ণয় যদি বাণিজ্যিক সংস্থাই করে, তাহা হইলে কেন্দ্রে একটি নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন কী?
তবে কি সমালোচনা হইতে বাঁচিবার তাড়নায় কেন্দ্রীয় সরকার এখন বাণিজ্যিক সংস্থাকে ‘খলনায়ক’ করিতে ব্যগ্র? কেন্দ্র টিকা কিনিবে ১৫০ টাকায়, রাজ্য ৪০০ টাকায়, এই ঘোষণায় দেশ জুড়িয়া শোরগোল উঠিয়াছে। এই বৈষম্যদুষ্ট, অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের দায় আপন মস্তক হইতে সরাইতে কি কেন্দ্র ব্যাকুল? তৎসহ টিকা কিনিবার দায় রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপাইয়া ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার দায় কাহার, এই প্রশ্নে চাপানউতোরের পরিচিত রাজনৈতিক খেলার জমিও তৈরি হইল। কিন্তু তাহাতেও শেষরক্ষা হইবে কি? টিকা জুগাইতে কেন্দ্রের ব্যর্থতা কেবল ভারতবাসী নহে, অন্য দেশের নাগরিকদেরও বিপন্ন করিয়াছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ-সহ বেশ কিছু দেশ ভারতের প্রতিষেধকের উপরে ভরসা করিয়া টিকার প্রথম ডোজ় দিয়াছে। যথাকালে দ্বিতীয় ডোজ় জোগান না দিতে পারিলে তাহা কেবল সরকারের ‘প্রতিষেধক কূটনীতি’র ব্যর্থতা নহে, ভারতের লজ্জা— অপরের বিপদে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়াও তাহা রাখিতে পারে নাই সে, আশ্রিতকে সুরক্ষা দিতে পারে নাই। বিশ্বের ‘পরিত্রাতা’ সাজিতে চাহিয়াছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অক্সিজেন, ভেন্টিলেটরের অভাব প্রকট হইতেই তাঁহাকে ভিক্ষার ঝুলি বাহির করিতে হইয়াছে।
ভারতের রাজ্যে রাজ্যে গণচিতার ধুম সারা বিশ্বকে আহত করিয়াছে। দেশের সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করিতে মোদী অভ্যস্ত, বিদেশের গণমাধ্যমকে থামাইবার সাধ্য তাঁহার নাই। তাঁহার সরকার ভ্রান্ত তথ্য, অস্বচ্ছ নীতির আলো-আঁধারি রচনা করিয়া দেশকে বিভ্রান্ত করিতেছে। বাহিরের জানলা দিয়া আলো আসিতেছে। শূন্য আস্ফালন ভুলিয়া সেই স্পষ্ট আলোকে নিজ চিত্ত, নিজ দেশকে দেখিতে হইবে ভারতবাসীকে। বিচার করিতে হইবে আপন রাজনীতির, যাহা জয়পরাজয়ের হিসাব করিয়া মানুষের প্রাণের দাম নির্ধারণ করিতেছে। জনকল্যাণের উপরে ক্ষমতাসীনের স্বার্থকে স্থান দিবার পরিণাম কী, তাহারই সাক্ষ্য দিতেছে টিকার জন্য প্রতীক্ষারত মানুষের সারি।