ফাইল চিত্র।
কুম্ভকর্ণ নাকি ছয় মাসে এক বার জাগিতেন। কেন্দ্রের ঘুম ভাঙিল এক বৎসর পরে। লকডাউন-পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকরা কেমন ছিলেন, জানিতে সমীক্ষা শুরু হইল ২০২১-এর এপ্রিলে। লকডাউন চলাকালীন পরিযায়ী শ্রমিকরা রেশন, সরকারি চিকিৎসা প্রভৃতি কোন কোন সরকারি পরিষেবা পাইয়াছেন, তাহাও নাকি জানা যাইবে এই সমীক্ষায়। ইহাই কি পরিযায়ী শ্রমিকের প্রতি কেন্দ্রের দায়বদ্ধতার নমুনা? তথ্য সংগ্রহ করা সরকারের কাজ, কিন্তু তাহা জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে নহে। ঠিক সময়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন অথবা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণই তাহার প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু গত বৎসর যে সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের সহায়তার প্রয়োজন তীব্র হইয়াছিল, তখন কেন্দ্রের সরকার তাহাদের প্রয়োজনের কোনও খবরই রাখে নাই। সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী জানাইয়াছিলেন, লকডাউনে কত পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হইয়াছে, সেই বিষয়ে কোনও তথ্য কেন্দ্রের নিকট নাই। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ঘরের উদ্দেশে পথে নামিলেন; তাহার পর দীর্ঘ পদযাত্রায় পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু, অনাহারে অচিকিৎসায় মৃত্যু, শ্রমিক ট্রেনে অমানবিক পরিস্থিতিতে মৃত্যু, অবসাদে আত্মহত্যা— কিছুই দেশবাসীর চক্ষুর অন্তরালে ঘটে নাই। নয়শতেরও অধিক মৃত্যুর ঘটনার বিস্তারিত প্রতিফলন ঘটিয়াছে সংবাদমাধ্যমে। তাহা ‘সরকারি তথ্য’ হিসাবে যাচাই করিবার, গ্রহণযোগ্য করিবার পদ্ধতি কি এতই কঠিন ছিল? দেশবাসী বিভ্রান্ত হইয়াছিল— এত শ্রমিকের মৃত্যু, না কি সে সম্পর্কে সরকারের উদাসীনতা, কোনটি অধিক লজ্জাজনক? প্রশ্ন উঠিয়াছিল, ইহা কি শ্রমিক-মৃত্যু অস্বীকার করিবার চেষ্টা?
কর্মহীন, বা স্থান-বিচ্যুত, রিক্তহস্ত শ্রমিক পরিবারগুলি কী প্রকারে দিন গুজরান করিতেছে, সে সম্পর্কেও তথ্য খুব কম নাই। দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা, সমাজকর্মী ও বিবিধ শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা নিয়মিত সমীক্ষা করিয়া তাহার হিসাব রাখিয়াছিলেন। খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবহণ, চিকিৎসা, আপৎকালীন নানা পরিষেবা ইত্যাদি প্রবাসী শ্রমিকরা কতখানি পাইয়াছেন, তাহার যে খণ্ডচিত্র প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা দেশবাসীর উদ্বেগ ও আশঙ্কার কারণ হইয়াছিল। সেই সকল সাক্ষ্যের ইঙ্গিত মানিয়াই নাগরিক সমাজ পরিযায়ী শ্রমিকদের সহায়তা করিতে অগ্রসর হইয়াছিল— পাকাপোক্ত সরকারি হিসাব মিলিবার অপেক্ষা করে নাই। কেন্দ্র অথবা রাজ্যগুলির শ্রম দফতরের আধিকারিকদেরই কি এই তথ্য সংগ্রহের এবং ব্যবস্থা গ্রহণের দায় ছিল না? সাধারণ নাগরিক যাহা পারিলেন, তাহার উদ্যোগ করিতেই সরকারের এক বৎসর ঘুরিয়া গেল— অতিমারি ফের ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিয়াছে।
বিলম্বে হইলেও সরকারের বোধোদয় হইয়াছে, ইহা সুসংবাদ। তবে, নাগরিক যে প্রশ্ন করিতেছেন, তাহার উত্তর দিতে হইবে কেন্দ্রকে। লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ কতখানি সার্থক? অতিমারির প্রকোপ চলিতে চলিতেই কেন সহস্রাধিক শ্রমিককে ফের ভিন্রাজ্যে ফিরিতে হইয়াছে রোজগারের জন্য? ‘আর্থিক প্যাকেজ’ ঘোষণা করিয়া স্বনিযুক্তির যে সকল প্রকল্পের কথা জানানো হইয়াছিল, তাহা কতখানি বাস্তবায়িত হইল? ফের যদি কখনও লকডাউন হয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কী ব্যবস্থা করিবে কেন্দ্র? স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া কেন্দ্র সে সকল বিবরণ দিবে দেশবাসীকে, ইহাই প্রত্যাশিত।