Politics

জাতি-জটিলতা

গত সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালকে ডেপুটেশন দেয় রাজ্যের আদিবাসী সংগঠনগুলি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৪ ০৮:০৪
Share:

—প্রতীকী ছবি।

জাতিসত্তার প্রশ্নটি আগে এই ভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিষিয়ে উঠেছে কি? ভারতের সপ্তদশ সংসদ শেষের মুখে। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন দোরগোড়ায় এসে পড়েছে। এমন সময়ে জাতিসত্তার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে প্রায় অভূতপূর্ব ভাবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক জঙ্গলমহল সফরে স্পষ্ট হল, কতটাই জটিল এবং বিস্ফোরক হয়ে উঠেছে এই প্রশ্ন। কয়েক বছর ধরে লাগাতার দাবি জানানোর পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার কুর্মি গোষ্ঠীকে জনজাতি তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে সদর্থক বার্তা দিতে শুরু করায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে আদিবাসী সংগঠনগুলির মধ্যে। কুর্মিদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া— কোনও নেতা বলছেন সরকারের সদর্থক প্রয়াসে তাঁরা সন্তুষ্ট, এবং প্রতীক্ষা করতে রাজি। আবার কোনও নেতা বলছেন, রাজ্যের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যম দেখা নেই, বরং যেটুকু এখন দেখা যাচ্ছে তা কেবলই ভোট-স্বার্থে মুখরক্ষার খাতিরে। বাস্তবিক, বিষয়টিতে এত দিন ততখানি প্রশাসনিক মনোযোগ যে দেওয়া হয়নি, এটা রাজ্য সরকারের দিক থেকে দায়িত্বস্খলনই বলতে হবে। কোন আদিবাসী সম্প্রদায়কে তফসিলি জাতিভুক্ত করা যায়, আর কাকে করা যায় না, এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বিরোধের মাত্রা কত ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত ও তীব্র সংঘর্ষময় হয়ে উঠতে পারে, মণিপুর তার উদাহরণ। এই রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলিকে এক পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল এত দিন, তার দায় তৃণমূল সরকার-সহ পূর্বতন সকল সরকারের উপরেই বর্তায়।

Advertisement

গত সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালকে ডেপুটেশন দেয় রাজ্যের আদিবাসী সংগঠনগুলি। তখনই বোঝা যায়, আদিবাসীদের ক্ষোভাগ্নির পরিমাণ ঠিক কতখানি। একে তো তাঁরা মনে করেন, কুর্মিদের এই স্বীকৃতি অপ্রাপ্য। তদুপরি, স্মারকলিপিতে এ কথাও ছিল যে, ভুল ভাবে, বা অন্যায় ভাবে যাদের এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তাদের বিষয়েও যেন তৎপরতার সঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়। জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের সুবিধা নেওয়ার জন্য এই শংসাপত্রের কী বহুল পরিমাণ অপব্যবহার হয়েছে, তা এত দিনে স্পষ্ট। অনেক সময়ে রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যবহার করেই এই কাজ হয়েছে। এই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এক দিন না এক দিন ঘনিয়ে ওঠারই কথা ছিল। মুখ্যমন্ত্রী একটি জাতি-সমীক্ষার কথা বলেছেন। কিন্তু এত দিনও সেই সমীক্ষা করা যায়নি কেন, এর কোনও উত্তর তাঁর কথায় পাওয়া যায়নি। সঙ্গত ভাবেই কুর্মি ও অন্য আদিবাসী, দুই মহলেই এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন উঠেছে— প্রথমত, অন্যত্র যে-হেতু এমন কোনও সমীক্ষা হয়নি, এ রাজ্যে কেন তা হবে। এবং দ্বিতীয়ত ওবিসি স্বীকৃতি ও সার্টিফিকেট বিতরণের ক্ষেত্রে যদি মুসলমানদের সমীক্ষা না করা হয়ে থাকে, তা হলে এ ক্ষেত্রে কেন তা হবে। ঘটনা হল, এ সব প্রশ্নের পিছনেই রাজনৈতিক বিরোধিতার স্বরটি যথেষ্ট স্পষ্ট, কিন্তু রাজ্যের শাসক দল সেই ঝুঁকি এড়াতেই পারে না। বিশেষত বিজেপি যে এই সংশয় ও ক্ষোভের ক্ষেত্রকে কাজে লাগাতে ও আদিবাসী এলাকায় নিজেদের
সমর্থন পাকা করতে সচেষ্ট, তা কয়েক বছর ধরেই দিবালোকের মতো উজ্জ্বল।

তবে কিনা, আদিবাসী রাজনীতির জটিলতায় বিজেপিও উদ্বেগহীন নয়। আদিবাসীদের একটি বড় অংশ অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধী। এ দিকে জাতীয় স্তরে বিজেপি এখন এ বিষয়ে সুর চড়াচ্ছে, এবং হিন্দু ভোটের মুখপানে চেয়ে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, আবার ক্ষমতায় ফিরলেই তারা এই বিধি পাশ করার কাজে নেমে পড়বে। সব মিলিয়ে পরিস্থিত সঙ্গিন। এটুকু কেবল পরিষ্কার যে, অন্য সব ক্ষেত্রের মতোই, জাতিসত্তার প্রশ্নটি আদতেই রাজনৈতিক, এবং পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ তা আরও বেশি করে রাজনৈতিক টানাপড়েনের ধারালো অস্ত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement