Laal Singh Chaddha

শেষের শুরু?

ধর্মকে স্বীকার করেও কর্মকে মান দেওয়া ভারত এখন অতীতের ছায়ামাত্র। তার বর্তমান যদি এই, তবে ভবিষ্যৎ কেমন হবে ভেবেও শিউরে উঠতে হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:০০
Share:

মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যবসা।

গণতন্ত্রে প্রত্যাখ্যানও এক অস্ত্র, স্বদেশি যুগে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের কথা ধরা আছে ইতিহাসে। কিন্তু আজকের, একুশ শতকের ভারতে কী বয়কট হচ্ছে? আমির খান অভিনীত লাল সিং চড্ডা চলচ্চিত্র বয়কট ‘আন্দোলন’ চলছে সমাজমাধ্যমে। টুইটারে ট্রেন্ডিং ‘বয়কট আমির খান’, হোয়াটসঅ্যাপে গড়াচ্ছে বিদ্বেষবিষ, কারণ সাত বছর আগে তাঁর করা একটি মন্তব্য, ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার আবহে তিনি বলেছিলেন এই দেশে তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। কারণ, আট বছর আগের একটি ছবিতে তাঁর চরিত্রটি হিন্দুধর্ম তথা দেবদেবী নিয়ে মজা করেছিল। তাই ২০২২-এ মুক্তি পাওয়া তাঁর ছবিটি প্রত্যাখ্যাত। হল থেকে উঠে গিয়েছে ক’দিনেই, মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যবসা। খোদ অভিনেতার আবেদনেও কাজ হয়নি।

Advertisement

হয়নি, কারণ আজকের ভারত অন্য পথে হাঁটছে। কোন পথে, কোন অধঃপাতের দিকে, আজকের বলিউড নিয়ে এই সমাজ- আচরণই তার প্রতীকী পরিচয়। মুম্বইয়ের চলচ্চিত্রজগতে বহু অভিনেতা রাজত্ব করেছেন, আর যা-ই হোক কারও ধর্মপরিচয় নিয়ে কদাচ প্রশ্ন ওঠেনি। শাহরুখ বা আমির খানের তিন দশকেরও বেশি দীর্ঘ অভিনয়জীবনে মানুষ তাঁদের অভিনয় নিয়েই আবেগী থেকেছে বরাবর, তাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কি না, তা ভুলেও কখনও মাথায় আসেনি— অন্তত বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগে। ধর্মীয় মেরুকরণ এখন নির্বাচনেও বিজেপির অস্ত্র, সমাজমন নিয়ন্ত্রণেও। বাইরে তাদের নেতা-মন্ত্রীদের প্রকাশ্য সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ, তার সমান্তরালে সমাজমাধ্যমে আই টি সেলের ধর্মের নামে নিরন্তর বিদ্বেষবিষ ছড়ানো, এ-ই হল আজকের ভারতের ছবি। জনমন বিষিয়ে দেওয়ার এই নির্লজ্জ ও উদ্ধত প্রকল্পে ছাড় নেই সেই অভিনেতারও, যিনি জীবনভর মন দিয়ে নিজের কাজটুকু আন্তরিক ভাবে করে গিয়েছেন, ঊর্ধ্বে থেকেছেন যে কোনও রকম বিভেদকামী মানসিকতার, এমনকি একের পর এক ‘দেশপ্রেমী’ ছবিও উপহার দিয়েছেন ভারতকে। তাঁর ছাড় যে নেই, তার একমাত্র কারণ তাঁর নাম-পরিচয়। ঠিক যে কারণে এই ভারতে এক জন মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, এক জন সিদ্দিক কাপ্পানের বিরুদ্ধে মামলা হয় ইউএপিএ আইনে, একই কারণে এক জন আমির খানের বিরুদ্ধেও ওঠে ছবি বয়কটের ধুয়ো। এই ভারতে এটাই বাস্তব, এ-ই সত্য।

সাধারণ নাগরিক তবে কী করবেন? বিদ্বেষ আর হিংসার এই ধুরন্ধর ফাঁদে পা দিয়ে যাবেন ক্রমাগত, বিশ্বাস করে যাবেন যা বলা হবে তা-ই, সমাজমাধ্যমের বিদ্বেষবিষ নিজেরা শুধু ধারণই করবেন না, উগরেও যাবেন টুইটার ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের দায়িত্বজ্ঞানহীন ‘রিটুইট’ ‘ফরোয়ার্ড’ আর ‘শেয়ার’-এ, পথে অফিসে বন্ধু-আড্ডায় পেশ করবেন সুচিন্তিত গম্ভীর মত: ‘যা রটে তার কিছু তো বটে!’ সমাজমাধ্যমের কার্যকারিতা নির্ভর করে সংখ্যাগুরুত্বের উপর, অত্যল্প সময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে বলেই সে এত শক্তিশালী, আর সেই সুযোগ নিয়েই সমাজমনে চলছে প্ররোচনা উস্কানি হিং‌সার চাষ। আজ তা এতই ক্ষমতাধর যে, চলচ্চিত্রের ব্যবসাকেও পথে বসাচ্ছে, পর্দার নায়ককে করে তুলছে বাস্তবের খলনায়ক। ধর্মকে স্বীকার করেও কর্মকে মান দেওয়া ভারত এখন অতীতের ছায়ামাত্র। তার বর্তমান যদি এই, তবে ভবিষ্যৎ কেমন হবে ভেবেও শিউরে উঠতে হয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement