প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থরা নিশ্চয়ই অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে মনে মনে প্রভূত ধন্যবাদ জানিয়েছেন। গুজরাতের বিধানসভায় আম আদমি পার্টির প্রতিনিধির সংখ্যা যত অল্পই হোক, বিরোধী ভোট ভাগ করে শাসক বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়ার ব্যাপারে কেজরীওয়ালের অবদান বিস্তর। কেবল আপ এবং কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত যোগ করে সেই অবদানের তল পাওয়া যাবে না, পরস্পরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে পরিচিত দু’টি দল বিরোধী পরিসরে অবতীর্ণ হলে সচরাচর শাসক দলের নিজের ভোটের অনুপাতও বেড়ে যায়— নির্বাচনী রাজনীতি আর নির্বাচনী পাটিগণিত এক বস্তু নয়। বস্তুত, গুজরাতের চিরাচরিত দ্বিমুখী নির্বাচনী রাজনীতি যে ভাবে ত্রিধাবিভক্ত হল, বিজেপির পক্ষে তার সুফল কেবল এ বারের বিজয়েই সীমিত থাকবে কি? দলনায়করা ভবিষ্যতেও অন্তত কিছু কাল তার ফসল তোলার প্রত্যাশা করলে সেই আশাকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। এবং, সম্মিলিত বিরোধী শক্তির অভাব লোকসভা নির্বাচনে কতটা ছায়া ফেলতে পারে, গুজরাত সম্ভবত সেই বিষয়েও নতুন সঙ্কেত দিল।
বিরোধী ভোটের বিভাজন অবশ্যই সাতাশ বছর একটানা শাসনের পরে অর্ধেকের বেশি ভোট পেয়ে রেকর্ড সংখ্যক আসন দখলের কৃতিত্বের প্রধান কারণ হতে পারে না। সেই কৃতির একটি বড় অংশ দাবি করতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। কেবল গুজরাত তাঁর স্বভূমি বলে নয়, এই নির্বাচনের উদ্যোগপর্বে ৩৬টি জনসভা এবং বহু প্রকল্প ঘোষণা সমেত যে বিপুল প্রচার তিনি চালিয়েছেন তার প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু উদ্যোগ শুরু হয়েছিল আগে, আটঘাট বেঁধে। রাজ্য সরকারের প্রতি অসন্তোষের মাত্রা বাড়তে দেখে মাঝপথে মুখ্যমন্ত্রী বদলের সিদ্ধান্ত ছিল তার অন্যতম। ভূপেন্দ্র পটেলের আবির্ভাব আত্মসংশোধন এবং পরিবর্তনের আশ্বাস দেয়, পাশাপাশি পাটীদারদের ক্ষোভকেও প্রশমিত করে। হার্দিক পটেলকে দলে ‘নিয়ে আসা’র অবদানও কম ছিল না। তবে, দৃশ্যত, এই সমস্ত প্রকৌশলের ঊর্ধ্বে যে বস্তুটি বিজেপির আকর্ষণকে ধরে রেখেছে তার নাম সংখ্যাগুরুবাদ। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ‘গবেষণাগার’ হিসাবে পরিচিত গুজরাতে এ বারও বিজেপির প্রচারে উৎকট বিদ্বেষের উচ্চারণ শোনা দেখা গিয়েছে, প্রথম সারির দলনেতারাও কটূক্তিতে বিরত থাকেননি। এই মেরুকরণের কাছে উন্নয়নের ঘাটতি বা জাতপাতের রাজনীতি দাঁড়াতে পারেনি। রাজ্যের অনগ্রসর এলাকায় এবং জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলেও শাসক দলের সাফল্য সেই সত্য জানিয়ে দেয়। উত্তরপ্রদেশের মতোই গুজরাতেও হিন্দুত্ববাদের জনপ্রিয়তা প্রবল।
এক দিকে সংখ্যাগুরুবাদ এবং বিজেপির শক্তিশালী ভোটযন্ত্র, অন্য দিকে আপ নামক তৃতীয় শক্তির প্রতিস্পর্ধা— এই পরিস্থিতি সামলানোর সামর্থ্য যে কংগ্রেসের নেই, সেই সত্যটিও উন্মোচিত। আপন দুর্বলতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট বোধও কি দলনেতাদের আছে? থাকলে, তাঁরা নির্বাচনী প্রচারে আরও অনেক বেশি চিন্তা এবং উদ্যমের প্রমাণ দিতে পারলেন না কেন? জনজাতি, মুসলিম, বিক্ষুব্ধ পাটীদার ইত্যাদি নানা গোষ্ঠীর সম্মিলিত সমর্থন নিয়ে ভোটে সফল হওয়ার খোয়াব দেখছিলেন? ‘খাম’ রাজনীতি অতীত এবং মৃত, এই সহজ কথাটি বোঝেননি? আপাতত হিমাচল প্রদেশের মন্ত্রিসভা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই তাঁদের নিয়তি, যদিও সেই গদিটুকু কত দিন ধরে রাখতে পারবেন, অন্য নানা রাজ্যের অভিজ্ঞতা সে বিষয়ে বিশেষ ভরসা দেয় না। সঙ্ঘ পরিবারের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের কালে রাজনীতির মানচিত্রে দেশের প্রাচীনতম দলটি উত্তরোত্তর কেবল দুর্বল নয়, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়। কিন্তু জরা এবং ব্যাধির কবল থেকে বাঁচবার জন্য প্রয়োজনীয় বিশল্যকরণী তাকে কে এনে দেবে?