—প্রতীকী চিত্র।
অশালীন, কুৎসিত, বিবমিষাজনক, লজ্জাকর... বিশেষণ বাছতে অভিধান উজাড় হয়ে যাবে, ভারতীয় জনতা পার্টির ভূতপূর্ব রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের অলোকসামান্য প্রতিভার যথেষ্ট ব্যাখ্যান করা যাবে না। অম্লানবদনে অকথ্যভাষণের স্বাভাবিক প্রতিভায় যে তাঁর তুলনা বিরল, অনেক দিন যাবৎ তার বহু পরিচয় তিনি দিয়েছেন। কিন্তু যথার্থ বড় মাপের খেলোয়াড় কখনওই আপন কৃতিত্বে সন্তুষ্ট হন না, উচ্চতর শৃঙ্গজয়ের অভিযানে নেমে পড়েন। সুতরাং পুরনো মেদিনীপুর থেকে নতুন বর্ধমান-দুর্গাপুরে ভোট চাইতে নেমেই দিলীপবাবু কালক্ষেপ না করে রুচিহীন কুকথার নতুন নজির গড়েছেন। এবং, মানতেই হবে, তিনি ধ্রুপদী শৈলীর খেলোয়াড়— রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে তাঁর সাম্প্রতিকতম উক্তিটি কেবল কদর্য নয়, কদর্যতার প্রাচীন ‘কপিবুক’ থেকে তুলে আনা। গালিগালাজের রাজনীতির ময়দানে এখন প্রতিদ্বন্দ্বী বিস্তর বটে, কিন্তু সরাসরি প্রতিপক্ষের পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা অনেকেই ভাবেন না, ভাবলেও সঙ্কোচবশত তা মুখে আনেন না। বিজেপির এই ‘প্রবীণ নেতা’র বোধ করি সে-সব বালাই একেবারেই নেই। তাঁর পরবর্তী আচরণেও কি সেই সত্যই ফাঁস হয়ে যায়নি? নিতান্ত দায়সারা ভঙ্গিতে ‘তা হলে আমি দুঃখিত’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থনে রকমারি টীকাটিপ্পনী জুড়েই তিনি নিরস্ত হননি, স্বল্পকাল পরেই ‘কী এমন বলেছি’ গোছের প্রশ্ন তুলে এবং নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর শব্দ প্রয়োগ করে আপন ‘মন কী বাত’ বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই ধারণাই উত্তরোত্তর জোরদার হয়েছে যে, তিনি আদৌ দুঃখিত, অনুতপ্ত বা লজ্জিত নন, নিতান্তই (দলীয় বড় কর্তাদের) চাপে পড়ে দুঃখপ্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন।
কুভাষা সতত সংক্রামক। বিজেপি নেতার কুৎসিত মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের বিবিধ মহল থেকে যে সব উক্তি বর্ষিত হচ্ছে, সেখানেও কুরুচির প্রকোপ প্রবল। এই ভাষা-সন্ত্রাস এ দেশের রাজনীতিতে ব্যতিক্রম নয়, নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, নির্বাচনের হাওয়া লাগলেই তার মাত্রা চড়তে থাকে। সেই কারণেই, মূল প্রশ্নটি খড়্গপুর বা দুর্গাপুরের জনৈক রাজনীতিকের সভ্যতা বা সুরুচির বোধ নিয়ে নয়। ব্যক্তি গৌণ, কিছু কিছু ব্যক্তি গৌণতর। কিন্তু যে ব্যক্তি দেশের, এবং অনেক রাজ্যের, শাসক দলের জনপ্রতিনিধি, দলের রাজ্য সভাপতির আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার অভিজ্ঞতা রাখেন এবং এখন লোকসভার সদস্য হতে চান, তাঁর আচরণ আর নিছক ব্যক্তিগত থাকে না। বারংবার এমন কুৎসিত কথা বলেও যদি তাঁর মতো লোকেরা পার পেয়ে যান, তবে দেশের অধোগামী রাজনীতির রুচি এবং মানের অবনমন আরও ভয়ানক আকার ধারণ করতে বাধ্য।
সেই আশঙ্কা নিবারণের দায়িত্ব কে নেবে? বিজেপির উপরমহল, ভোটের বাজারে বেগতিক দেখে, তাঁকে তিরস্কার করেছেন, কিন্তু এই দলের বিবিধ স্তরের নায়কনায়িকাদের পরুষভাষণের যে পরম্পরা চলে আসছে, তাতে লোকদেখানো ধমকধামকের বেশি কোনও পদক্ষেপের ভরসা কম। আর নির্বাচন কমিশন? সরাসরি নির্বাচনী প্রচারের আচরণ-বিধি লঙ্ঘনের জন্য কমিশন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধান করতে পারে; প্রচারপর্বের শুরুতেই তেমন পদক্ষেপ করা হলে হয়তো ভোটের মরসুমে অ-সভ্যতার উপদ্রব অনেকটা দমন করা যেত। কিন্তু বর্তমান জমানায় শাসক দলের নেতা এবং প্রার্থীকে কমিশন প্রকৃত শাস্তি দেবে? দিতে পারবে? ধন্য আশা কুহকিনী। সুতরাং শেষ ভরসা জনসমাজ, নাগরিক, ভোটদাতা। অপরাধ যাঁরই হোক, যে দলেরই হোক, এই ধরনের অপভাষাকে রাজনীতির পরিসর থেকে সপাটে বিদায় করার শেষ দায় নাগরিকদেরই। প্রশ্ন হল, তাঁরা কি এই চূড়ান্ত অ-সভ্যতায় যথেষ্ট ক্ষুব্ধ? না কি, এই কদর্যতাকেই তাঁরাও স্বাভাবিক বা অনিবার্য জ্ঞানে মেনে নেবেন এবং ‘আগে বলো তুমি কোন দলে’ নীতি অনুসারে গালিগালাজের প্রতিবাদ করবেন অথবা হাততালি দেবেন?