কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা। —ফাইল চিত্র।
ভারতে কৃষির পরিস্থিতি কী, সে বিষয়ে সংসদে প্রশ্ন উঠল বটে, তবে প্রশ্নটা ছিল সহজ, আর উত্তরও তো জানা। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা জানালেন, আর্থিক বৃদ্ধির মোট যুক্ত মূল্যের (গ্রোস ভ্যালু অ্যাডেড বা জিভিএ) নিরিখে কৃষির অবদান ১৯৯০-৯১ সালে ছিল ৩৫%, তা থেকে কমে এখন ১৫% হয়েছে। এই হ্রাস কৃষির উৎপাদন কমার জন্য নয়, বরং শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধির জন্যে। কথাটা ভুল নয়, নতুনও নয়। সব উন্নত দেশেই অর্থনীতিতে শিল্প এবং পরিষেবার অবদানই থাকে বেশি, কৃষির অবদান তুলনায় অল্প। বরং প্রশ্ন করা চলে, বিশ্বের গড় যেখানে চার শতাংশ, সেখানে ভারতে এখনও কৃষির অবদান পনেরো শতাংশ কেন। প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ১৯৬০-৬১ সালে অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ছিল ৪৬%, ২০১০-১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১৪ শতাংশে। তার পর এক দশক পার হয়েছে, কৃষির অবদানে বিশেষ হেরফের হয়নি। এমনটাই প্রত্যাশিত, না কি এই স্থিতাবস্থা উদ্বেগজনক, কৃষিমন্ত্রী বলেননি। বরং আশ্বাস দিয়েছেন যে, কৃষিতে বার্ষিক বৃদ্ধি চার শতাংশ। কেবল এই তথ্যে আশ্বস্ত হওয়া যায় না। হেক্টর-প্রতি ফসল উৎপাদনের নিরিখে ভারত পিছিয়ে— ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়ার অর্ধেক ধান ফলায় ভারত, চিনের তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। ভারতে চাষের দুই-তৃতীয়াংশ বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বৃষ্টি কমায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে— গত দু’বছর গমের উৎপাদন কমেছে।
সেচের জল যখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে, রাসায়নিক সারের দাম মাত্রা ছাড়াচ্ছে, তখন কী করে ভারতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়বে, সে প্রশ্নেরই উত্তর আজ দরকার। সেই সঙ্গে উঠবে ফসল-বৈচিত্রের প্রশ্নটিও। ভারতের জনসংখ্যার সুষম পুষ্টির জন্য দুধ, ডিম, ফল সকলের কাছে সুলভ করতে হবে। চাই কৃষি উৎপাদনের নকশায় পরিবর্তন। কৃষিজমির অধিকাংশই এখনও ধান-গমে নিয়োজিত। পশ্চিমে প্রযুক্তির প্রয়োগে, বাণিজ্যিক হারে চাষ বাড়িয়ে কৃষিতে বৈচিত্র এসেছে, তাকে লাভজনক করা গিয়েছে। ভারতে কৃষির উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে রয়েছে খাদ্য-নিরাপত্তা, তেমনই দরিদ্রের আয়ের প্রশ্নটি। অর্থনীতিতে কৃষির অবদান কমছে, কিন্তু অর্থ রোজগারের জন্য কৃষির উপর নির্ভরতা কমেছে কতটুকু? এখনও তিন-চতুর্থাংশ চাষি কৃষির উপরে নির্ভরশীল, অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি। গত দশ বছরে কেন্দ্রের, এবং বিভিন্ন রাজ্যের শাসক দল চাষির আয় বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছিল। অনুদান মিলেছে, আয় বাড়েনি।
অপচয় কমিয়ে, পরিবেশ রক্ষা করে ফলনে বৃদ্ধি, এবং সর্বস্তরের কৃষকের আয় বাড়ানো যায় কী ভাবে, সেই আলোচনার জন্য সংসদকে ব্যবহার করা যেত। কেন্দ্রের সরকার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ আনতে চায়— উপগ্রহ ছবির ব্যবহার, জেনেটিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, রোবটিক্স-এর মাধ্যমে পরিমিত সার, কীটনাশকের প্রয়োগ ইত্যাদি। এর প্রতিটিই কার্যকর হতে পারে, কিন্তু ‘চতুর্থ কৃষিবিপ্লব’ এখনও একটি ধারণামাত্র, তার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার, তার গোড়ার কাজগুলিই হয়নি। অর্থনীতিতে কৃষির অবদান কমলেও, কৃষির গুরুত্ব কম নয়। দরিদ্রের আয়ের নিরাপত্তা, দেশবাসীর খাদ্যসুরক্ষা, মাটি-জলের সংরক্ষণ— সবই জড়িয়ে রয়েছে কৃষির সংস্কারের সঙ্গে।