— ফাইল চিত্র।
বিপন্ন ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ অ্যামাজ়ন বৃষ্টিঅরণ্য। সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, মানুষের দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশ পরিবর্তনের জেরে গত বছর এই অর্ধশতকের ভয়ঙ্করতম খরার কবলে পড়ে এই অঞ্চলটি। বস্তুত, ব্রাজ়িল, কলম্বিয়া, ভেনেজ়ুয়েলা এবং পেরু-সহ ন’টি অ্যামাজ়ন বৃষ্টিঅরণ্য রাষ্ট্রই অনাবৃষ্টিতে প্রভাবিত হয়। এমনিতে অ্যামাজ়নে খরা অস্বাভাবিক ঘটনা না হলেও, গত বছরের অনাবৃষ্টিকে ‘ব্যতিক্রম’ রূপেই অভিহিত করছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে এই অঞ্চলের বহু নদীর জলস্তরের লক্ষণীয় পতন ঘটে, ভয়ঙ্কর দাবদাহের প্রাদুর্ভাব হয় এবং বিপন্ন হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা। বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় রাখার ক্ষেত্রে এ-যাবৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে এই অরণ্য। কিন্তু গবেষণা বলছে, মূলত বৃক্ষচ্ছেদন বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জীববৈচিত্রপূর্ণ বৃষ্টিঅরণ্যের ধ্বংসের প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এর কারণে অরণ্যের বেশ কিছু অংশ শুষ্ক অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে, যা উল্টে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ করছে। খরার ভয়ঙ্কর রূপ সবার গোচরে আসে যখন গত বছর অক্টোবরে এই অঞ্চলের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে একটি হ্রদের শতাধিক বিরল প্রজাতির ডলফিন-সহ অন্যান্য জলাশয়ে হাজার হাজার মাছের মৃত্যু হয়। জলস্তর হ্রাসের ফলে নদী-তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষও, যাঁদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম জলপথ, প্রভাবিত হন। বাড়ে দাবদাহপূর্ণ দিনের সংখ্যাও। প্রসঙ্গত, অ্যামাজ়নের বহু দেশই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীপ্রবাহের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু জলস্তর হ্রাসের ফলে এখানকার জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির উৎপাদন প্রভাবিত হয়। ব্রাজ়িলে যেমন একটি প্রকল্পকে বন্ধ করে দিতে হয়, তেমনই ইকুয়েডর এবং ভেনেজ়ুয়েলায় দেখা দেয় ভয়ঙ্কর বিদ্যুৎ ঘাটতি। বেশ কিছু দেশকে সে ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয় ডিজ়েল চালিত প্রকল্পের উপরে।
এমনিতে এই অঞ্চলে শুষ্ক অবস্থার সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক আবহাওয়া প্রক্রিয়া ‘এল-নিনো’র কারণে, যা বৃদ্ধি করে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। যা শুধু দক্ষিণ আমেরিকারই নয়, প্রভাবিত করে বিশ্বের বৃষ্টিপাতের ধরনকেও। কিন্তু বিজ্ঞানীদের দাবি, গত বারের চরম খরার মূলে ছিল মানব প্ররোচিত পরিবেশ পরিবর্তন, যা ভূপৃষ্ঠস্থ জল হ্রাস করে দু’ভাবে। প্রথমত, উষ্ণায়নের জেরে সাম্প্রতিক কালে আমাজনে অতিরিক্ত কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে জুন এবং নভেম্বরের মাঝে। সাধারণ সময়ে এই পর্বটি কিছুটা শুষ্ক থাকে, তবে সম্প্রতি সেই সামান্য বৃষ্টিতেও টান পড়েছে। দ্বিতীয়ত, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জেরে বাষ্পীভবনের কারণে কমছে উদ্ভিদ-সহ মাটির জলীয় অংশ। এমতাবস্থায়, উষ্ণায়ন যদি বাড়তে থাকে তবে চরম খরা পরিস্থিতি আরও ঘন ঘন দেখা যাবে বলেই আশঙ্কা। সেই সঙ্গে বর্তমান হারে বৃক্ষচ্ছেদন চললে অচিরেই সেই যুদ্ধে হার মানতে হবে অ্যামাজ়নকে। তবে আশার কথা, সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে ২০২৩ সালে ব্রাজ়িল এবং কলম্বিয়া আগের বছরের তুলনায় বৃক্ষচ্ছেদন হ্রাস করেছে। শুধু তাই নয়, ব্রাজ়িলের রাষ্ট্রপতি লুলা দে সিলভা এটি ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরই সঙ্গে বিভিন্ন দেশকেও অবিলম্বে গ্রিনহাউস নিঃসরণ কমাতে হবে। অ্যামাজ়নকে বাঁচাতে হবে নিজেদের স্বার্থেই— রাষ্ট্রনেতাদের এই সত্যটি দ্রুত উপলব্ধি করা প্রয়োজন।