সম্প্রতি এই সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু দেশের তথা রাজ্যের সমকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ জানাইতে গিয়া প্রস্তাবনা ও পরিপ্রেক্ষিত হিসাবে পঞ্চাশ-ষাটের দশকের নবীন পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক মানসের কথা লিখিয়াছেন। সেই মনে এক প্রবল গর্বের অনুভূতি ছিল। বাঙালির শিক্ষা ও সংস্কৃতির গর্ব। তাহার উদার সহিষ্ণু চেতনার গর্ব। এক কথায়, সেই গর্ব বৃহৎ বাঙালির। বৃহতের সাধনা যাহার ব্রত, বৃহতের অন্বেষণ যাহা ধর্ম। পশ্চিমবঙ্গের বয়স এখন সত্তর অতিক্রান্ত। বয়স পরিণতি দেয়, জরাও আনে। কালের গতি পশ্চিমবঙ্গকে স্বধর্মে স্থিত রাখিতে পারে নাই, বঙ্গবাসী তাহার সাধনা হইতে বিচ্যুত হইয়া সঙ্কীর্ণ ও তুচ্ছ কুনাট্যে মাতিয়াছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র উদিত হইলেও সে মুখ তুলিবার প্রেরণা অনুভব করে না, চাঁদ দেখিতে চাহিলেও সে নর্দমার জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখে, উহাতেই তাহার সুখ। ভূমানন্দ। কূপমণ্ডূক অস্তিত্বের সঙ্কীর্ণ পরিসরে ক্রমাগত আপনার চারি পাশে আবর্তন করিতে করিতে তাহার মানসিকতা উত্তরোত্তর এক বিজাতীয় অসহিষ্ণুতার শিকার হইয়া পড়িতেছে, আজ সে কেবল দল পাকাইয়া ক্ষমতার আস্ফালন করিতে পারে, ক্ষমতা দখলের জন্য দল পাকাইতে পারে, সেই অন্তহীন রেষারেষিতেই তাহার পরম তৃপ্তি। কৌশিক বসু যে গর্বের কথা বলিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজের মন হইতে তাহা বেমালুম লোপাট হইয়া গিয়াছে। এত বড় ক্ষতি তাহার আর কিছুতে হয় নাই।
এই ক্ষয়ের ইতিহাস দীর্ঘ, বহুচর্চিত। ষাটের দশকের বিধ্বংসী দিনগুলিতেই এই রাজ্যের সার্বিক অবনমন শুরু হইয়াছিল। তাহার পিছনে বামপন্থী রাজনীতির বঙ্গীয় কারবারিদের দায় এবং দায়িত্ব বিপুল। সমাজের সর্বস্তরের অন্তরে ও মস্তিষ্কে মধ্যমেধার আনুগত্য এবং মতান্ধ অসহিষ্ণুতার বিষাক্ত পাঁচন সঞ্চারে তাঁহাদের তৎপরতার সীমা ছিল না। তিন দশকের অধিক বাম শাসনের অবকাশে সেই গরল বাঙালির প্রকৃত পানীয়ে পরিণত হইয়াছিল। তাঁহাদের উত্তরসূরিরা সেই বিষবৃক্ষেরই ফল। পালাবদলের পরেও সেই নূতন শাসকরা পুরাতন বিষ দূর করিবার কোনও চেষ্টা করেন নাই, বরং গত এক দশকে তাহার প্রকোপ আরও বাড়িয়াছে, সমাজে ও রাজনীতিতে দেখা গিয়াছে রকমারি কুনাট্য। এবং, আজ বিরোধী রাজনীতির পরিসরে যাঁহারা অষ্টাদশ শতকের বর্গি আক্রমণের শৈলীতে বাংলায় প্রতিপত্তি বিস্তারের চেষ্টা চালাইতেছেন, তাঁহাদের দাক্ষিণ্যে সেই কুনাট্য প্রায় রাতারাতি এক ভয়াবহ স্তরে পৌঁছাইয়াছে। আশঙ্কা হয়, ইহা নূতন বিভীষিকার সূচনামাত্র। গর্ব নহে, পশ্চিমবঙ্গের সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন বাঙালি আজ যদি কেবল গভীর লজ্জা এবং গভীরতর উদ্বেগ বোধ করে, তাহাকে দোষ দিবার উপায় নাই।
দীর্ঘকালের এই অন্ধকূপ হইতে পশ্চিমবঙ্গের মুক্তি আবশ্যক। রাজ্য জুড়িয়া দলতন্ত্রের নিকৃষ্টতম প্রদর্শনী চলিতেছে, বিভেদ ও হিংসার হুঙ্কার ধ্বনিত হইতেছে, কেবল তাহার নিন্দা ও সমালোচনাই আজ আর যথেষ্ট নহে, সব রকমের বিষাক্ত তুচ্ছতা ও বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সমবেত শুভবুদ্ধির অবস্থান হইতে সমস্বরে দাবি জানাইতে হইবে নাগরিক সমাজকে। আত্মঘাতী সঙ্কীর্ণতা এবং অসহিষ্ণুতার চোরাবালি হইতে আর্থিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রশস্ত পরিসরে উত্তরণের দাবির মধ্য দিয়াই নির্বাচনকে তাহার গণতান্ত্রিক মর্যাদা দেওয়া সম্ভব। নির্বাচন যে নিছক এই দল, ওই দল এবং সেই দলের পসরা হইতে একটিকে বাছিবার বাজার নহে, তাহার মধ্য দিয়াই রাজ্যের মানুষ আপন অগ্রগতির দিশা খুঁজিয়া লইতে পারে, সেই দিশায় রাজ্যকে চালনা করিবার জনাদেশ বলবৎ করিতে পারে, এই মৌলিক সত্যটি প্রতিষ্ঠা করিবার মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। তাহার সদ্ব্যবহার করিতে পারিলে নাগরিক আপন গর্ব ফিরিয়া পাইবেন। অন্য পথ নাই।