অন্য রাজ্যে, বিশেষত বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে নারী-নির্যাতন, শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, এই কথাটিকে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেতারা যখন ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চান, তখন তাঁদের দ্ব্যর্থহীন ভাবে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, অন্য রাজ্যের অন্যায় কখনও এ রাজ্যের অন্যায়ের পক্ষে যুক্তি হতে পারে না। ঠিক সে ভাবেই প্রধানমন্ত্রী মোদীকেও মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গে নারীসুরক্ষার প্রশ্নে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তখন তা নিতান্তই রাজনৈতিক কুম্ভীরাশ্রু বলে প্রতিভাত হয়। কারণ, নারীর সম্মান রক্ষায় তাঁর দলের ট্র্যাকরেকর্ড যেমন কহতব্য নয়, তেমনই তাঁর দলের শাসনে থাকা রাজ্যে নারী-নির্যাতনের ঘটনায়, এবং তার প্রতিক্রিয়ায় সরকার ও দলের ভূমিকা। প্রধানমন্ত্রীর হিরণ্ময় নীরবতাও গভীর ভাবে সমস্যাজনক। তালিকা সাজিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই— সে তালিকা হাওয়ায় ভাসছে সর্বত্রই— কয়েকটি নির্দিষ্ট ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিলেই যথেষ্ট হবে। মণিপুরে যখন প্রবল নারীনিগ্রহ চলছে, প্রধানমন্ত্রী তখন টুঁ শব্দটিও করেননি— বিরোধীদের অভিযোগ, তাঁর সেই নীরবতা সে রাজ্যে বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থেই। জম্মুর কাঠুয়ায় মাত্র আট বছর বয়সি এক মুসলমান বালিকার ধর্ষণ ও হত্যার পর তিন মাসেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর রুটিন প্রতিক্রিয়া পেতে। তাঁর রাজ্য গুজরাতে বিলকিস বানো মামলার অপরাধী থেকে তাঁর লোকসভা কেন্দ্রে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপি ছাত্রনেতা— দলীয় সমর্থকরা যখন তাদের ফুল-মালায় বরণ করে নিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কোনও আপত্তি জানাননি। ফলে এখন যাঁরা অভিযোগ তুলছেন যে, আর জি কর-কাণ্ডে মোদীর ‘উদ্বেগ’-এর সঙ্গে নারীসুরক্ষার তেমন সম্পর্ক নেই— তা নিতান্তই রাজনৈতিক, এই মওকায় রাজ্যের শাসক দলকে প্যাঁচে ফেলার কৌশল— তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিজেপিরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কথা। মহিলাদের বিষয়ে একাধিক বার তিনি জনসমক্ষে এমন মন্তব্য করেছেন, যা কোনও সাংবিধানিক পদাধিকারীর পক্ষে শুধু অশোভন নয়, ঘোর অন্যায়ও। কখনও তিনি মেয়েদের স্বাধীনতার পরিবর্তে সুরক্ষার পক্ষে সওয়াল করেছেন; কখনও বলেছেন, মেয়েরা পুরুষের সমকক্ষ হতে চাইলে ঘর ধ্বংস হয়ে যায় ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সুমধুর নয় বলেই হাওয়ায় কথা ভাসে। লক্ষণীয়, তবুও প্রধানমন্ত্রী কখনও এ কথাগুলিতে আপত্তি করেননি। সম্ভবত এতে তিনি আপত্তিজনক কিছু দেখেননি বলেই। এবং, শুধু আদিত্যনাথই তো নন, বিজেপির ছোট-বড় নেতা-মন্ত্রীদের মুখে এমন নারীবিদ্বেষ দুর্লভ কোনও বিষয় নয়। তবে, মুখের কথার চেয়ে বড় বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী আপত্তি জানাননি— ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে দেশের প্রথম সারির কুস্তিগিররা যৌন হেনস্থার স্পষ্ট অভিযোগ জানিয়ে বিপুল আন্দোলনে নামা সত্ত্বেও শ্রীসিংহ দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রীর স্নেহবঞ্চিত হননি। এগুলি যে নারীর মর্যাদা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক মনোভাবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ নয়, তা বোধ হয় তাঁর অন্ধ ভক্তরাও মানবেন।
অভিজ্ঞতা বলে, রাজনীতির কোনও মওকাই প্রধানমন্ত্রী ছাড়েন না। আর জি কর-কাণ্ডও সম্ভবত তাঁর কাছে তেমনই একটি সুযোগ, তার বেশি কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির জন্য নারীর মর্যাদা রক্ষার কথা বলা প্রয়োজন, তাই তিনি বলেছেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের দশ বছরের কার্যত একটি মুহূর্তও তাঁর এই মানসিকতার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে না, সে কথা জেনেও বলেছেন। ভারতের দুর্ভাগ্য যে, মেয়েদের সুরক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নও শেষ অবধি ক্ষুদ্র রাজনীতির পাঁকে আটকে যায়। দেশের মানুষ অভিজ্ঞতায় বুঝে নিয়েছেন, এমন মর্মান্তিক মৃত্যুও রাজনীতিকদের নিজস্ব হিসাবের বাইরে আর কিছু দেখাতে পারবে না। কোনও দলের নেতাকেই নয়।