ফাইল চিত্র।
ভারী শব্দের কারিকুরি আছে, প্রতিশ্রুতিও বিস্তর। কিন্তু চাকচিক্যের আস্তরণটি সরাইয়া দিলে হাতে কী পড়িয়া থাকিবে? এমন প্রশ্ন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেটে উল্লিখিত বিভিন্ন বিষয় লইয়া উঠিয়াছে। পরিবেশের ক্ষেত্রেও অন্যথা হয় নাই। আপাতদৃষ্টিতে বাজেটে পরিবেশ গুরুত্ব পাইয়াছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তাঁহার বাজেট বক্তৃতায় বহু বার স্বচ্ছ এনার্জি, নির্মল পরিবেশ, ক্লাইমেট অ্যাকশন-এর ন্যায় শব্দবন্ধ ব্যবহার করিয়াছেন। এবং বোধহীন অপব্যবহারের পরিবর্তে বিবেচনার সঙ্গে সম্পদ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলিয়াছেন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের জন্য এই বৎসর বরাদ্দ বাড়ানো হইয়াছে ৫.৬%। কিন্তু বিশ্লেষণ করিলে বুঝা যায়, এই ঘোষণার মধ্যে বিস্তর ফাঁক বর্তমান।
যেমন বলা হইয়াছে, কার্বন নিঃসরণ রুখিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে মোট জ্বালানির ৫-৬ শতাংশ ‘বায়োমাস’ ব্যবহার করা হইবে। অথচ বায়ুদূষণের ক্ষেত্রটি যথেষ্ট গুরুত্ব পাইল না। কমিশন ফর এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট (সিএকিউএম)-এর বাজেট বরাদ্দে হ্রাস করা হইল। দিল্লি এবং রাজধানী অঞ্চলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সিএকিউএম-এর ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ। সেইখানে গত বৎসরের ২০ কোটি হইতে বরাদ্দ কমিয়া হইল ১৭ কোটি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ঘটা করিয়া সূচনা হইয়াছিল ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’-এর। এই বৎসর তাহাতে কোনও বাড়তি বরাদ্দ করা হয় নাই। পরিবেশ লইয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী বিশেষ ভাবিত, অথচ সার্বিক ভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে হয় বাজেট কমিয়াছে, নয় অপরিবর্তিত রহিয়াছে— এই দুইয়ের মধ্যে কোনওরূপ যুক্তিসঙ্গত যোগসূত্র খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। বরাদ্দ কমিয়াছে উপকূল রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষেত্রেও। ফলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিরোধ, বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা সুরক্ষা এবং জীববৈচিত্র সংরক্ষণের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হইবে নিঃসন্দেহে। এ-হেন অসামঞ্জস্যের চিত্র পরিবেশ লইয়া ঘোষণায় সর্বত্র বিদ্যমান।
এবং এই বাজেটে এমন অনেক প্রকল্পের উপর জোর দেওয়া হইয়াছে, যাহাতে সার্বিক ভাবে পরিবেশের ক্ষতি হইবার সমূহ সম্ভাবনা। উদাহরণ হিসাবে গতি শক্তি প্রকল্পের কথা বলা যাইতে পারে। রাস্তা, রেলপথ, বিমানবন্দর, গণপরিবহণ-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণের যে উদ্যোগ এই প্রকল্পে করা হইয়াছে, তাহাতে দেশ জুড়িয়া প্রায় ১৫ লক্ষ হেক্টর জমি এবং ৪৪ লক্ষ মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা। ইহাতে পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হইবে, তাহার মোকাবিলা করা হইবে কী উপায়ে, স্পষ্ট উত্তর নাই। ইতিমধ্যেই ‘উন্নয়ন’-এর প্রবল জোয়ারে উত্তরাখণ্ড প্রাকৃতিক ভাবে বিপর্যস্ত। আশঙ্কা, বিপর্যয়ের সেই অভিঘাত আরও অনেক দূর বিস্তৃত হইবে। সর্বোপরি, এই বাজেটে নদী সংযুক্তিকরণের যে কথা বলা হইয়াছে, তাহাতে পরিবেশবিদরা সিঁদুরে মেঘ দেখিতেছেন। ইহার ফলে নদী তাহার নিজস্ব চরিত্রটি হারাইবে, হারাইবে জীববৈচিত্র। ঘন ঘন বন্যার আশঙ্কাটিও উড়াইয়া দিবার নহে। বাজেট ঘোষণায় চমক এবং প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন— এই দুইয়ের মধ্যে এক বিশাল ফাঁক বর্তমান। অর্থমন্ত্রী, আরও অনেক ক্ষেত্রের ন্যায় পরিবেশের ক্ষেত্রেও সম্ভবত সেই কথাটি বিস্মৃত হইয়াছিলেন।