ফাইল চিত্র।
ঘোরতর উত্তেজনায় উদ্বেল নির্বাচনী প্রচারের ময়দানে মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রামের বহুচর্চিত বৃত্তান্তে ‘নূতন’ টীকা সংযোজন করিলেন। তিনি নন্দীগ্রামে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চের ভয়াবহ গুলিচালনার ঘটনায় প্রাক্তন সহকর্মী এবং বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বী অধুনা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী ও শিশির অধিকারীর নাম জড়াইয়া দিয়া বলিয়াছেন, তাঁহাদের অনুমতি ব্যতীত ওই এলাকায় (আড়াই মাসের অবরোধ ভাঙিয়া) পুলিশ— বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ— ঢুকিতেই পারিত না। ঘটনার চতুর্দশ বৎসর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সংযোজনটি আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক। ইতিহাস শব্দটির অর্থ: ইতি হ আস, অর্থাৎ ইহা এইরূপই ছিল বা ঘটিয়াছিল। কী ঘটিয়াছিল, মুখ্যমন্ত্রী তাহার ‘ভিতরের খবর’ দিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথাকে বেদবাক্য মনে করিবার দায় নাগরিকের নাই। নাগরিক বরং প্রশ্ন তুলিতে পারেন, তিনি এমন তথ্য এত দিন প্রকাশ করেন নাই কেন? যাঁহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁহারা সঙ্গী ছিলেন বলিয়া? এখন তাঁহারা বিরোধী, সম্মুখসমরে অবতীর্ণ, অতএব সহসা গোপন ইতিহাস প্রকাশ্য হইল? রাজনীতির লীলা সত্যই বিচিত্র।
বিচিত্রতর ঠেকিতে পারে সিপিআইএমের অন্তর্ভুক্ত, অথবা অনুগামী বঙ্গীয় বামপন্থীদের একাংশের প্রতিক্রিয়া। নির্বাচনী প্রচারে তাঁহারা স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা কোণঠাসা, তদুপরি ‘প্রধান প্রতিপক্ষ’ স্থির করিবার জটিল অঙ্ক মিলাইতে বেসামাল। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর আকস্মিক ‘সংবাদ প্রতিবেদন’টি তাঁহাদের দৃশ্যত প্রভূত উৎসাহ দিয়াছে। এবং অত্যুৎসাহে কিঞ্চিৎ আত্মহারা হইয়া তাঁহারা অনেকেই সহসা বলিতে শুরু করিয়াছেন, নন্দীগ্রামের ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তাঁহার সরকার তথা সিপিআইএম দলের কোনও দায়ই ছিল না, সকলই ষড়যন্ত্র— যে ষড়যন্ত্রের কথা এখন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর কথায় প্রমাণিত হইল। নির্বাচনী বৈতরণির সম্মুখে দাঁড়াইয়া সিপিআইএম অনুরাগীরা তবে এই বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সত্যবাক্য’কেই পারানির কড়ি হিসাবে ব্যবহার করিতে আগ্রহী! বুদ্ধদেববাবু নিজে বা তাঁহার দল আনুষ্ঠানিক ভাবে এই মুক্তকচ্ছ আত্মপ্রশস্তিতে যোগ দেন নাই, বরং সংযমের পরিচয় দিয়াছেন, কিন্তু বাবু যত বলেন পারিষদদলে যথারীতি তাহার সহস্রগুণ বলিতেছেন!
এখন তরজার কাল। কিন্তু অন্তত একটি সত্য স্মরণ করা জরুরি। নন্দীগ্রামের ঘটনা লইয়া সংশয় প্রথম হইতেই প্রবল ছিল। কে কোথায় কী ভাবে গুলি চালাইয়াছিল, বহিরাগত এবং ভিতরের লোকেরা সংঘর্ষে কত দূর জড়িত ছিল, বিবিধ অত্যাচারের বহুলপ্রচারিত কাহিনিগুলির কতখানি বাস্তবানুগ ছিল— এই সকল বিষয়েই সংবাদমাধ্যমে তথা সামাজিক পরিসরে ক্রমাগত প্রশ্ন উঠিয়াছে, বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্যের অসঙ্গতি এবং স্ববিরোধও বারংবার প্রকট হইয়াছে। সুতরাং, ষড়যন্ত্রের কাহিনি শুনিয়া আকাশ হইতে পড়িবার কোনও কারণ নাই। বরং গোড়ার কথাটি স্বীকার করা দরকার। চৌদ্দ বৎসর আগে রাজ্য সরকার নন্দীগ্রামে যথার্থ প্রশাসন বজায় রাখিতে ব্যর্থ হইয়াছিল বলিয়াই সেখানে মাৎস্যন্যায় জারি হয়, তাহার পরিণতিতে ভয়াবহ মাসুল গনিতে হয় ওই অঞ্চলের মানুষকে, এবং রাজ্যবাসীকে। এই ব্যর্থতার মূলে ছিল গণতন্ত্রের বিকৃতি, যাহার দায় সে দিনের শাসকরা এড়াইতে পারেন না। পরবর্তী পর্বেও সেই বিকৃতি চলিয়াছে, কলুষিত হইয়াছে প্রশাসন। আজ নন্দীগ্রামে নির্বাচন। তাহার প্রচারপর্বেও সুস্থ গণতন্ত্রের আদর্শ বারংবার লঙ্ঘিত হইয়াছে। আপাতত নাগরিকের প্রত্যাশা এবং দাবি— নির্বাচনের দিনটি সেই ধারার বাহিরে থাকিবে। যদি প্রত্যাশা পূর্ণ হয়, ভোটপর্ব শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হয়, তবে তাহা হইবে ইতিহাসের এক অতি উজ্জ্বল ঘটনা। কেবল নন্দীগ্রামের পক্ষে নহে, গোটা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে।