মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাব আজ অনস্বীকার্য। মোবাইল প্রযুক্তির কারণে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসেই শিক্ষা থেকে সামাজিকতা, এমনকি বিনোদনের রসদও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। অতিমারি পর্বে এই প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা আগের তুলনায় বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সঙ্কটকালে শিক্ষার গতি যে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি, তার কারণ এই প্রযুক্তি। কিন্তু অতিনির্ভরতার ফলও অনেক সময় ভাল হয় না। যেমন, গেমিং। অভিযোগ, অতিমারি কালের মোবাইল-নির্ভরতা কমবয়সিদের মধ্যে বাড়িয়েছে গেমিং-এ আসক্তি। গেমিং-এর যে সবটুকুই খারাপ, তেমনটা নয়। বরং, জানা গিয়েছে, অনেক মোবাইল গেমিং বুদ্ধিমত্তা ও সৃষ্টিশীলতাকে শাণিত করে। প্রশিক্ষণ, পরীক্ষানিরীক্ষা এমনকি গবেষণার কিছু ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয় গেম। যেমন, ২০১৬ সালে ডিমেনশিয়া সংক্রান্ত বৈশ্বিক গবেষণার সাহায্যার্থে অ্যালঝাইমার্স রিসার্চ ইউকে, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়া-র সঙ্গে মিলে একটি ব্রিটিশ গেমিং সংস্থা তৈরি করে সি হিরো কোয়েস্ট নামে একটি গেম। অন্য দিকে, গেমিং শিল্পে বিশ্বে সবচেয়ে বড় বাজারগুলির অন্যতম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে ভারত। ফলে এই ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ছাত্রছাত্রীদের উজ্জ্বল কেরিয়ার গড়ারও সুযোগ রয়েছে।
সমস্যাটা, ভাল এবং খারাপ— দুটো দিকের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার। যার বিচ্যুতির ফলেই মানুষ শিকার হয় আসক্তির। কোভিডের সময় সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইনে বিনোদন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না শিশু বা কিশোর জীবনে। অভিভাবকদেরও সেই বিপদ আটকানোর পথটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে অযাচিত ভাবেই নিছক অবসরযাপনের রসদটি শেেষ পরিণত হয় কু-অভ্যাসে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মোবাইল গেমিং-এর ক্ষতিকর প্রভাব কেবল শরীর, মনেই আটকে থাকে না। জীবনের নানা ক্ষেত্রেও তা ছড়িয়ে পড়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই আসক্তি শিশু-কিশোরদের মধ্যে প্রবল সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। ফলে, স্বাভাবিক ভাবেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কেরিয়ারের উপর। শুধু তা-ই নয়, গেম খেলতে না দেওয়ার কারণে আত্মহত্যা, এমনকি হত্যার খবরও পাওয়া যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কিছু ক্ষেত্রে অল্প বয়সেই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে সন্তানের আসক্তি কমাতে অভিভাবকদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল কেড়ে নিয়ে বা কড়া শাসনে এই অভ্যাস ছাড়ানোর পন্থা নিতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এটা স্পষ্ট যে, আগামী দিনে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে গেমিং-এর মতো ক্ষেত্রগুলি আরও উন্নত হবে। সে ক্ষেত্রে এগুলিকে কী ভাবে কেউ তার ব্যক্তিগত জীবনে ব্যবহার করবে, সেই সিদ্ধান্তটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিনোদনের অন্যতম উপকরণটি যেন অজানতে আসক্তির পর্যায়ে চলে না যায়, সে দিকে নজর রাখতে হবে। এক দিকে গেমিং-দক্ষতাকে কেন্দ্র করে ভারতকে প্রযুক্তির দুনিয়ায় এগোতে হবে, তেমনই শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ থাকার পথটি যাতে বিনষ্ট না হয়, তা-ও দেখতে হবে। সাঁড়াশি সঙ্কট, নিঃসন্দেহে। কিন্তু সাঁড়াশির দু’টি মুখই সমান জরুরি।