প্রতীকী ছবি।
রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে ঔষধ সঙ্কটের যে চিত্র বার বার সংবাদে আসিতেছে, তাহা উদ্বেগজনক। অতি প্রয়োজনীয় ঔষধগুলির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে শূন্য হাতে ফিরিতে হইতেছে। কেবল দামি ঔষধ নহে, বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় ঔষধ নাই, বহু জীবনদায়ী ইঞ্জেকশন অমিল, এমনকি কুকুরে কামড়াইবার চিকিৎসার ‘অ্যান্টি র্যাবিস’ ইঞ্জেকশনও নাই। ব্লক স্তরের হাসপাতাল হইতে মেডিক্যাল কলেজ, সর্বত্র এই চিত্র প্রকট হইয়াছে। কারণ, সরকার ঔষধের খরচ মিটাইতে পারিতেছে না। ঔষধ সরবরাহকারী সংস্থাগুলির নিকট বহু টাকা বকেয়া; তাহা না মিটাইলে ব্যবসায়ীরা আর ঔষধ পাঠাইতে নারাজ। ইতিপূর্বেও সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ঔষধ এবং পরীক্ষা না মিলিবার অভিযোগ উঠিয়াছে। তবে এই বারের সঙ্কট দীর্ঘ, এবং তাহার নিরসনের উপায় লইয়া সরকারের তরফে কোনও উচ্চবাচ্য নাই। এই বারে প্রধান উদ্বেগ: সকল সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ঔষধের খরচ যে রূপ বাড়িয়াছে, তাহা সরকার আদৌ টানিতে পারিবে কি না, কোথা হইতে সেই টাকা আসিবে, সেই প্রশ্ন উঠিয়াছে।
এই অর্থসঙ্কটের শিকড় তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনের প্রথম পর্বে। ২০১৩ সালে রাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, সকল হাসপাতালে সকল চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ঔষধ বিনামূল্যে দেওয়া হইবে, এবং পরীক্ষাগুলিও বিনামূল্যে হইবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন জানাইয়াছিলেন, তাঁহার সরকার ওই খাতে ৪৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছে। ইহার পর ২০১৬ সালে সরকারি হাসপাতালের সকল শয্যাই বিনামূল্যের, অর্থাৎ ‘ফ্রি বেড’ বলিয়া ঘোষিত হয়। তৃণমূলের শাসনকালে বেশ কিছু নূতন ‘সুপার স্পেশালিটি’ হাসপাতাল এবং নূতন মেডিক্যাল কলেজ নির্মিত হইয়াছে, ফলে সরকারি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যাও দ্রুত বাড়িয়াছে। বাম আমলের শেষে একাত্তর হাজার হইতে আজ মোট শয্যার সংখ্যা ছিয়ানব্বই হাজার ছাড়াইয়াছে। সরকারি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের সর্বোচ্চ স্থানে, বলিতেছে ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি জাতীয় স্তরের রিপোর্ট। বিনামূল্যে ঔষধের আকর্ষণেও সরকারি হাসপাতালগুলিতে রোগীর সংখ্যা বহু গুণ বাড়িয়াছে। অচিকিৎসা, অপচিকিৎসা হয়তো কমিয়াছে, কিন্তু খরচ বাড়িয়াছে। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন খাতে কেন্দ্র হইতে প্রাপ্ত অর্থ, এবং তৎসহ রাজ্যের বরাদ্দ ঔষধের খরচ মিটাইবার জন্য যথেষ্ট কি? না হইলে ঔষধের বকেয়া টাকা মিটিবে কী করিয়া? রাজ্য সরকার কখনও তাহা স্পষ্ট করে নাই।
বিরোধীরা বার বার ‘মেলা-খেলায়’ অর্থ নষ্ট করিয়া ঔষধের খরচ কমাইবার অভিযোগ তুলিয়াছেন। অপচয় কমিলে ভাল, কিন্তু তাহাই যথেষ্ট নহে। অতিমারি-উত্তর কর্মহীনতা, ক্ষুধা, এবং দারিদ্রের তীব্রতার মোকাবিলায় বিবিধ জনকল্যাণমূলক প্রকল্প রাজ্য সরকার সহসা বন্ধ করিতে পারিবে না। অতএব ঔষধের বিপুল খরচের কী ব্যবস্থা হইবে, তাহা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। ঔষধের অভাবকে কখনও বিরোধীর অপপ্রচার, কখনও চিকিৎসকদের দুর্নীতি বলিয়া খারিজ করা অন্যায়। যদি রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ঔষধ রাজ্য জুগাইতে না পারে, তাহা সরকারকে স্বীকার করিতে হইবে। তাহাতে রোগীর খরচ না কমিলেও, অন্তত বিভ্রান্তি কমিবে, সময় বাঁচিবে।