—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সন্দেশ মানে খাবার, খবরও। আত্মীয়-বন্ধুর কুশল-জিজ্ঞাসা করতে গেলে হাতে মিষ্টান্ন থাকবে না, তা কি হয়? সৌহার্দের সঙ্গে মিষ্টির এই সংযোগ বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে, একে এড়ানো সহজ নয়। অথচ, মিষ্টি হেসে মিষ্টি খাওয়ার মানুষ ক্রমশ কমছে। বয়স্কদের একটা বড় অংশকে তো সন্দেশ-রসগোল্লার দিকে তাকাতেই নিষেধ করেন চিকিৎসকরা। তরুণ-তরুণীরাও ভুগছে মিষ্টি-ভীতিতে। পঁয়ত্রিশ পেরোলেই রক্তে শর্করা বাড়ার চিন্তা, পঁচিশ না-পেরোতে ওজন বাড়ার আশঙ্কা, আর সব বয়সেই প্রলোভন বনাম সংযমের লড়াই চলতে থাকে। অথচ, মিষ্টি না নিয়ে কারও বাড়ি ‘বিজয়া করতে’ যাওয়া যেমন অসৌজন্য, তেমনই অতিথিকে থালায় মিষ্টি সাজিয়ে দিলে প্রত্যাখ্যানও অভদ্রতা। তাই অভ্যাগতের তরফে ‘অতগুলো পারব না, ও দুটো তুলে নিন’ ধরনের কাতরোক্তি, আর গৃহস্বামীর তরফে ‘আহাহা, ওটা আমাদের পাড়ার দোকানের বিখ্যাত প্রাণহরা,’ গোছের উৎসাহদান চলতেই থাকে। সমাজের একটা অংশের অবশ্য এমন উৎসাহের প্রয়োজন হয় না। এঁদের জীবনদর্শন বহু আগে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন গুপী গাইনের বয়ানে, “মুন্ডু গেলে খাবটা কী।” যত ক্ষণ মুন্ডু রয়েছে, তত ক্ষণ খেয়ে যেতে হবে, এই সহজ জীবনবোধে তাঁরা অনুপ্রাণিত, মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্টে শুগার, কোলেস্টেরল বা ইউরিক অ্যাসিডের সংখ্যার ভ্রুকুটি এঁদের বিন্দুমাত্র বেসামাল করতে পারে না। কিন্তু এমন বীরের হৃদয় নিয়ে ক’জনই বা জন্মেছে। অতএব মিষ্টির প্যাকেট হাতে সহাস্য অতিথি দেখলে অনেকেরই একই সঙ্গে জিভে জল এবং বুকে কাঁপুনি অনুভূত হয়। মনে মনে হিসাব চলে, কত সন্দেশে কত ক্যালোরি, কাল ক’টা খাওয়া হয়ে গিয়েছে, আজ ক’টা খাওয়া চলে।
স্বাস্থ্য আর সৌজন্যের এই সঙ্কট থেকে বেরোনোর পথ খোঁজার সময় এসেছে। ‘ও ক’টা মিষ্টি খেলে কিছু হবে না,’ এই অভয়বাণী অসার স্তোকবাক্য, বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই জানেন। পাশ্চাত্যে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি প্রচার চলছে, ‘শুগার ইজ় দ্য নিউ টোব্যাকো’— চিনির ক্ষতি করার ক্ষমতা তামাকের সমান। বিজ্ঞানের বিচারে এই দাবি হয়তো বিতর্কিত, কিন্তু এর প্রধান উদ্দেশ্য নিজের খাবারের গুণমানের প্রতি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ। ভারতীয়দের জন্য এ কথাটি বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য, কারণ এখানে ডায়াবিটিসের হার উদ্বেগজনক। গত বছর প্রকাশিত একটি নমুনা সমীক্ষার ফল থেকে ইঙ্গিত মিলেছে যে, ভারতে ডায়াবিটিসে (মধুমেহ বা বহুমূত্র রোগ) আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়েছে। আরও তেরো কোটি মানুষ ডায়াবিটিসের ঠিক আগের ধাপে (‘প্রি-ডায়াবিটিস’) রয়েছেন। ভারতীয় তথা দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে প্রি-ডায়াবিটিস থেকে ডায়াবিটিসে এগোনোর হার বিশ্বে সর্বাধিক। পশ্চিমবঙ্গের চার জনের এক জন রয়েছেন প্রি-ডায়াবিটিস পর্যায়ে, চোদ্দো শতাংশ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত। এই হার বিশ্বের গড় হার ৯.৩ শতাংশের (২০১৯) চেয়ে অনেকটাই বেশি।
চিনিকে তামাকের গোত্রে ঠেলতে যাঁরা সক্রিয়, তাঁরা মনে করান যে তামাকের মতো চিনির মধ্যেও নেশা ধরানোর ক্ষমতা রয়েছে — অর্থাৎ চিনি খেলে আরও বেশি চিনি খাওয়ার প্রতি ঝোঁক তৈরি হবে। তেমনই, তামাকের প্রতি আকর্ষণ যেমন কেবল ব্যক্তির অসংযমের সমস্যা নয়, যদিও সে ভাবেই তাকে দেখাতেই সবাই তৎপর। আসলে তামাকের প্রতি একটা গোটা শিল্প সুকৌশলে নেশাসক্তি তৈরি করে চলেছে, তেমনই ‘শুগার লবি’ বা চিনি উৎপাদক শিল্পগোষ্ঠীও চিনির সমস্যাগুলিকে আড়াল করছে, এবং অতিরিক্ত মিষ্টি এড়িয়ে সুস্বাস্থ্য তৈরির পথে সরকারি ও অ-সরকারি চেষ্টাকে প্রতিহত করছে। ভারতেও চিনি উৎপাদকদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রচুর। তবে সব দোষই সরকারের ঘাড়ে চাপানোর অভ্যাস থেকে বেরোনোও দরকার। বিজয়ায় মিষ্টি পরিবেশন একটি সামাজিক প্রথা, যা বদলানোর সময় এসেছে। সমাজকেই মিষ্টির বিকল্প স্থির করতে হবে।