ডাকঘর নাটকে মাধব দত্তের সংলাপ মনে আসিতে পারে: ‘যখন ছিল না, তখন ছিলই না’। অতিমারি কাটিয়া যাইবার পর, ভারতে অনলাইনের সুযোগবঞ্চিত পড়ুয়াদের সম্পর্কে কি এমন কথাই বলা হইবে? সম্প্রতি প্রকাশিত এক সর্বভারতীয় সমীক্ষায় চোখ রাখিলে তদ্রূপ আশঙ্কাই জন্মায়। রিপোর্ট বলিতেছে, শহরাঞ্চলে অনলাইন ক্লাসে নিয়মিত হাজিরা দিতে সমর্থ পড়ুয়ার শতাংশ মাত্র ২৪, গ্রামাঞ্চলে সাকুল্যে ৮। শহরে ১৯ শতাংশ ও গ্রামে ৩৭ শতাংশ পড়ুয়ার পাকাপাকি ভাবে লেখাপড়ার পাট চুকিয়া গিয়াছে। গত তিন মাসে পরীক্ষা না-দিবার হারটিও যথাক্রমে ৫২ ও ৭৪ শতাংশ। এই সমীক্ষাই প্রমাণ করিতেছে যে, যাহাদের অনলাইনের সুবিধা নাই, তাহাদের শিক্ষাগ্রহণের উপায়ও নাই। অতিমারির দাপটে দেড় বৎসর যাবৎ ক্লাসঘর বন্ধ রাখিবার পরেও খরচসাপেক্ষ বিকল্প ব্যতীত অপর কিছু বন্দোবস্ত ভাবিয়া উঠিতে পারেন নাই দেশের কর্তাব্যক্তিরা। বরং, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাটিই শনৈঃ শনৈঃ নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করিতেছে।
প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয়ের হিসাব ধরিলে দেশের তিন-চতুর্থাংশই অবস্থিত গ্রামীণ অঞ্চলে। বিপ্রতীপে, অনলাইন শিক্ষার দুই স্তম্ভ, স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট পরিষেবার এমন সিংহ ভাগ উপভোগ করে না গ্রামীণ ভারত। অর্থাৎ, যে এলাকায় অধিকাংশ পড়ুয়ার বাস— অন্তত প্রাথমিক শিক্ষার নিরিখে— সেই এলাকায় বিকল্পের প্রস্তুতিটি তৈরি করিবার মতো ভিত্তিই অদ্যাবধি নির্মাণ করিয়া উঠা যায় নাই। এহ বাহ্য। ইন্টারনেট ব্যবস্থা ক্রমশ ডালপালা মেলিতেছে, করোনা-কালে স্মার্টফোন কিনিবার সংখ্যাও দ্বিগুণ হইয়াছে, কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতা না থাকিলে দুইটি বস্তুই ধোঁকার টাটি বলিয়া মনে হইতে পারে। অতিমারিতে মানুষ বহুলাংশে রোজগার খোয়াইয়াছেন, অসংগঠিত ক্ষেত্র ব্যাপক ভাবে ধাক্কা খাইবার ফলে গ্রামাঞ্চলেও সেই অভিঘাত প্রবল। ইহার প্রভাব সন্তানদের লেখাপড়ার উপর পড়িয়াছে। বহু পরিবারের আর সন্তানকে পড়াইবার মতো আর্থিক সংস্থান নাই, প্রযুক্তি জোগাড় করিবার ক্ষমতা দূরস্থান। ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল— শিক্ষাব্যবস্থার গণ্ডি হইতে চিরতরে ছিটকাইয়া যাইতেছে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী।
দায়িত্ব সম্পূর্ণত প্রশাসনের। উক্ত সমীক্ষাই বলিতেছে, ৯০ শতাংশেরও বেশি ছাত্রছাত্রী ক্লাসঘরে ফিরিতে ইচ্ছুক, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষকও অনলাইন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কথা বলিতেছেন। সমস্যাটি বস্তুত বিকল্পভাবনার গোড়ায় নিহিত। শিক্ষাকর্তারা ক্লাসঘরের এমনই এক পরিবর্তের কথা ভাবিয়াছেন, এবং তাহা চালাইয়া লইতেছেন, যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার ভিতর ব্যবস্থাপনাটুকু থাকিলেও শিখিবার প্রশ্নটি ক্রমশ বাদ পড়িয়া যাইতেছে। শিক্ষকতা বা শিক্ষাগ্রহণকে অবশিষ্ট ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা স্বগৃহে কর্মের ন্যায় ভাবিলে ভুল হইবে। উহা দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের সওয়াল, নূতন মন গড়িয়া তুলিবার প্রয়াস। তাহা কোনও এক প্রকার আলম্বের মাধ্যমে সারিয়া দিবার ব্যাপার নহে, এতটুকু ত্রুটি-বিচ্যুতি আগামী বহু যুগের ক্ষতিসাধন করিতে পারে। এবং, যে ব্যবস্থা সকল পড়ুয়াকে স্থান দিতে পারে না, তাহা কি কদাপি নির্বিকল্প হইতে পারে? ক্লাসঘর খুলিবে কি না তাহা একান্তই প্রশাসনের বিবেচ্য, কিন্তু যথাযথ বিকল্প দিশার দাবিটি জোর গলায় জানাইতেই হয়।