Supreme Court of India

এবং সংশয়

চার দশক যাবৎ এই অনুচ্ছেদের বিচারবিভাগীয় ব্যাখ্যা অনুসারেই কার্যত ব্যক্তি-সম্পত্তির অধিগ্রহণ তথা রাষ্ট্রীয়করণের পথ খুলে রাখা হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২২
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সংবিধান যে একটি জীবন্ত এবং জঙ্গম দলিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি আরও এক বার জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন নয় জন বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের এই রায়ের নির্যাস: জনস্বার্থের যুক্তি দেখিয়ে সরকার যে কোনও ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারে না। এই সিদ্ধান্ত প্রকৃত অর্থেই ঐতিহাসিক। সত্তর-আশির দশকে সর্বোচ্চ আদালতের একাধিক রায়ের ফলে জনস্বার্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিগ্রহণে সরকারের অধিকার সুপ্রসারিত হয়েছিল। অতঃপর, নানা পরিমার্জন সত্ত্বেও, মূলত সেই ধারাই বহাল ছিল। চার দশক পরে সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্ট ভাষায় সেই ঐতিহ্যের বিরোধিতা করেছে, নয় জনের মধ্যে আট জন বিচারপতি জানিয়েছেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি ক্ষেত্রবিশেষে অধিগ্রহণ করার যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু সর্বক্ষেত্রে নয়।

Advertisement

এই পরিবর্তনের ভিত্তিতে আছে সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিমালার একটি অংশ, যেখানে বলা হয়েছে: সরকার এমন নীতি প্রণয়ন করবে যার ফলে কমিউনিটি বা গোষ্ঠীর বস্তুগত সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ জনসাধারণের কল্যাণে অর্থাৎ বৃহত্তর জনস্বার্থে বণ্টিত হয়। চার দশক যাবৎ এই অনুচ্ছেদের বিচারবিভাগীয় ব্যাখ্যা অনুসারেই কার্যত ব্যক্তি-সম্পত্তির অধিগ্রহণ তথা রাষ্ট্রীয়করণের পথ খুলে রাখা হয়েছে। মঙ্গলবারের রায়ে বিচারপতিরা বলেছেন, এত দিন সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদটির যে ব্যাখ্যা চালু ছিল, তা এক বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী। স্পষ্টতই, মতাদর্শ বলতে এখানে এক ধরনের ‘সমাজতান্ত্রিক’ মতের কথা বলা হয়েছে, যে মত অনুসারে রাষ্ট্রীয়করণই জনকল্যাণের সদুপায়, যে উপায় অবলম্বন করেই রাষ্ট্রচালকরা গোষ্ঠীর বৃহত্তর কল্যাণ সাধন করতে পারেন, সেই লক্ষ্য পূরণের প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সহজেই লঙ্ঘনীয়। আট জন বিচারপতির মতেই অনুচ্ছেদটির এই ব্যাখ্যা ঠিক নয়, অন্তত এখন আর ঠিক নয়। কেন ঠিক নয়, তা প্রাঞ্জল করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন: কিছু কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে তবেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে গোষ্ঠীর সম্পদ বলে গণ্য করা চলে, তখনই সংবিধানের নির্দেশ প্রয়োগের প্রশ্ন ওঠে, না হলে ব্যক্তিমালিকানা অলঙ্ঘনীয়।

শর্তগুলি ঠিক কী হবে, অর্থাৎ কোন কোন অবস্থায় সরকার ব্যক্তির সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারবে? মাননীয় বিচারপতিদের বক্তব্য: এই সমস্ত প্রশ্ন ঠিক হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। শর্ত নির্ধারণে মতাদর্শের ভূমিকাকে তাঁরা অস্বীকার করেননি, কিন্তু তাঁদের মতে দেশের সংবিধানের ব্যাখ্যায় কোনও পূর্বনির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয় মতাদর্শ চলতে পারে না, সরকারি মত এবং পথ কী হবে সেটাও জনসাধারণের মতামতের টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত এবং পরিবর্তিত হতে পারে। উনিশশো সত্তর-আশির দশকের প্রবল রাষ্ট্রবাদ থেকে আজকের ভারতের জনমত বহু দূরে সরে এসেছে। বাস্তবের এই জঙ্গমতাকে অস্বীকার করে সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলির অর্থসন্ধান করলে ভুল হয়। সর্বোচ্চ আদালতের এই অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। এবং গুরুত্বপূর্ণ বলেই, সতর্ক থাকা দরকার যে— এই রায়ের পরে ব্যক্তিমালিকানার অধিকারের অপব্যবহারের সুযোগ যেন বেড়ে না যায়, সেই অধিকার যেন জনস্বার্থের যথার্থ প্রসারে বাধা সৃষ্টি না করে। বাস্তব এই যে, দুনিয়ার বহু দেশের পাশাপাশি ভারতেও গত তিন দশকে সম্পত্তির মালিকানা এবং তার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সামাজিক অসাম্য তীব্র গতিতে বেড়েছে। অতিকায় এবং কার্যত একচেটিয়া সম্পদশালীদের আধিপত্য পৌঁছেছে অভূতপূর্ব মাত্রায়। রাষ্ট্রের উপর তাদের প্রবল প্রভাব এতটাই প্রকট যে ‘সাঙাততন্ত্র’ শব্দটি এখন সর্বজনপরিচিত। এই পরিস্থিতিতে সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিতে যে রক্ষাকবচের সংস্থান করা হয়েছিল, সেটি হরণ করে নেওয়ার আশঙ্কা বাড়বে না তো? সংশয় থেকেই গেল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement