জনতাকে কী ভাবে ছত্রভঙ্গ করিতে হয়, কলিকাতা পুলিশ তাহা জানে না, কথাটি বিশ্বাস করিবার মতো নহে। ইতিহাস, এমনকি সাম্প্রতিক ইতিহাস বলিতেছে, প্রতিবাদী জনতা সামলাইবার অভিজ্ঞতা তাহাদের বিপুল। তবু, বামপন্থী সংগঠনগুলির নবান্ন অভিযানের দিন কলিকাতা পুলিশ তাহাদের যাবতীয় অভিজ্ঞতা লালবাজারে তালা দিয়া রাখিয়া ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত হইল। মিছিল হইতে উস্কানি ছিল, এই অজুহাত পাতে দিবার যোগ্য নহে, কেননা মিছিলের জনতা যে বিশৃঙ্খল হইতে পারে, মারমুখী হইতে পারে, এই সব কথা পুলিশের অজানা থাকিবার কথা নহে। এই কথাটিও জানা যে, জনতার— বিশেষত নিরস্ত্র জনতার— শক্তির সহিত পুলিশের শক্তির কোনও তুলনাই চলে না। ফলে, অধিক শক্তিধরের দায়িত্ব স্বীকার করিয়া সংযত থাকাই পুলিশের কর্তব্য ছিল। কলিকাতার রাজপথ সাক্ষী, পুলিশ সেই দিন নিজের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ। মইদুল ইসলাম মিদ্যা নামক এক যুবক নিজের প্রাণের মূল্যে বুঝাইয়া দিলেন, রাষ্ট্রশক্তির সামনে মানুষ কতটা অসহায়। এই মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জরুরি। এবং, দোষীদের শনাক্ত করিয়া কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা প্রয়োজন। হাতে লাঠি বা বন্দুক থাকিলেই যে তাহার যথেচ্ছ প্রয়োগ করা চলে না, মানবাধিকার নামক বস্তুটি শত প্ররোচনা সত্ত্বেও পুলিশকে মানিয়া চলিতে হয়, কলিকাতার অভিজ্ঞ পুলিশবাহিনীকে আরও এক বার কথাটি স্মরণ করাইয়া দেওয়া জরুরি।
পুলিশ স্বপ্রবৃত্ত হইয়া মারমুখী হইয়াছিল, না কি রাজনৈতিক নেতৃত্বের তরফে তেমন নির্দেশ ছিল, এই প্রশ্নটি আসিবেই। ঘটনার দায় তাই শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে লইতে হইবে। মানিতে হইবে যে, এক দিকে বিজেপির রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নিন্দা করিয়া অন্য দিকে নিজেরা মানবাধিকার দলন করা যায় না। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে পুলিশি বাড়াবাড়ির অসংখ্য নিদর্শন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থকদের উপর হিংসাত্মক আক্রমণের ঘটনাও প্রচুর। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য আজিকার বিরোধী দলগুলিরও সমধিক আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ ভোলা যাইবে না। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের কথা মনে পড়িতে পারে। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশের গুলিতে ১৩ জন বিক্ষোভকারী নিহত হইয়াছিলেন। বলিলে অত্যুক্তি হইবে না, স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম কলঙ্কময় দিন ছিল সেই জুলাই-দিবস। ঘটনাচক্রে, সেই দিন যুব কংগ্রেসের যে নেত্রী মহাকরণ অভিযানের পুরোভাগে ছিলেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বেই মইদুল ইসলাম মিদ্যার প্রাণ গেল। শাসকের রঙ পাল্টায়, কিন্তু আচরণ বদলায় না। গণতান্ত্রিক পরিসরে বিরোধিতা দমন করিতে বাম জমানাতেও যেমন পুলিশ ব্যবহৃত হইত, এখনও তেমনই হইতেছে। প্রতিবাদের সম্মুখীন হইবার শক্তি শাসকরা অর্জন করিয়া উঠিতে পারেন নাই। অথবা, শাসকের কুর্সিতে বসিলেই গণতন্ত্রের সেই পাঠটি তাঁহারা বিস্মৃত হইয়া থাকেন, রাজনৈতিক রঙ নির্বিশেষে।
তাই, মইদুল ইসলাম মিদ্যা কোন দলের সমর্থক ছিলেন, কোন দাবিতে তিনি নবান্ন অভিযানে যোগ দিয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রতিবাদে কতখানি প্ররোচনা ছিল, এই প্রশ্নগুলি ছাপাইয়া এই মুহূর্তে আরও অনেক বড় হইয়া উঠিতেছে মইদুল ইসলামের পরিচিতিটুকু: তিনি পশ্চিমবঙ্গের এক নাগরিক, যিনি নিরস্ত্র অবস্থায় রাষ্ট্রের নিকট নিজের দাবি পেশ করিতে গিয়াছিলেন। সেই দাবি পেশ করা তাঁহার গণতান্ত্রিক অধিকার। পুলিশ, অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তি, তাঁহার সেই অধিকার খর্ব করিল তো বটেই, তাঁহার জীবনের অধিকারও হরণ করিল। শাসকের কুর্সিতে বসিলে গণতন্ত্র সম্বন্ধে সচেতন থাকিবার কাজটি কতখানি কঠিন, এই মৃত্যু তাহা আরও এক বার প্রমাণ করিল।