Shantiniketan

ভগ্ন ঐতিহ্য

কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হচ্ছে, আর্কিয়োলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে সৌধটি পুনর্নির্মাণ করা হবে। কিন্তু ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ কি সম্ভব?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:২৪
Share:

গাছ ভেঙে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ছাতিমতলা। নিজস্ব চিত্র

এই আক্ষেপের সান্ত্বনা নেই। শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর প্রাণকেন্দ্র ছাতিমতলা, সেখানকার ঐতিহ্যময় বেদি ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের বাণীসম্বলিত মর্মর ফলক ভেঙে পড়ার সংবাদ বেদনাদায়ক। “তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি” লিখিত ফলকটি যেমন বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীদের কাছে, তেমনই পর্যটকদের কাছেও শান্তিনিকেতনের দর্শন ও সংস্কৃতির এক অভিজ্ঞান। আপাতদৃষ্টিতে এই ঐতিহ্যময় সৌধের ধূলিসাৎ হওয়ার কারণটি প্রাকৃতিক— কয়েক দিন ভারী বৃষ্টির ফলে দু’টি শাল গাছ ভেঙে পড়েছে ছাতিমতলার বেদি ও সৌধের উপর। ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ আধিকারিক বলেছেন, সম্ভবত বহু পুরনো দু’টি গাছ ভিতর ভিতর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই বৃষ্টিতে ভেঙে পড়েছে। প্রশ্ন হল, শাল গাছ দু’টি যে বিপদ ঘটাতে পারে, তা জানা ছিল না কেন? রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকদের কি এটাই কাজ নয়? দুই বছর আগে ঐতিহ্যবাহী ঘণ্টাতলার উপরেও একটি বটগাছ ভেঙে পড়ে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তার পরেও বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণের অন্তর্গত গাছগুলির স্বাস্থ্যের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সজাগ হয়নি কেন?

Advertisement

কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হচ্ছে, আর্কিয়োলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে সৌধটি পুনর্নির্মাণ করা হবে। কিন্তু ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ কি সম্ভব? পুরনো বেদি অথবা ফলকের মতো দেখতে, অবিকল তেমনই আর একটি নির্মাণ তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু তা হবে এক নিপুণ প্রতিকৃতি। ব্যক্তির মতোই, ঐতিহাসিক সৌধগুলির মূল্য তাদের বিকল্পহীনতায়। একটি নির্মাণের সঙ্গে সংযুক্ত অগণিত মানুষের স্মৃতি তাকে অমূল্য করে তোলে। ছাতিমতলায় শান্তিনিকেতনের প্রাচীনতম স্মৃতি বিধৃত রয়েছে। মনে করা হয়, এখানেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বিশ্রাম নিয়েছিলেন রায়পুরের জমিদারদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়ার পথে, এবং পরে কুড়ি বিঘা জমি কিনে নেন। সে অর্থে শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর সূচনা এই ছাতিমতলা থেকেই। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা দিবস-সহ বিশেষ দিনগুলির উপাসনা এখানে হয়েছে বরাবর। তবু যে ছাতিমতলার সুরক্ষা কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্ব পায়নি, এটা বিস্ময়ের কথা বটে।

অথবা, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বিশ্বভারতী অনন্য কেন, সে প্রশ্নের উত্তর শেষ অবধি মিলেছে তার ইতিহাস থেকে। রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক মানবতাবাদ, প্রকৃতির সাযুজ্যে জ্ঞান ও শিল্পের চর্চা, বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজের উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতার সঙ্গে বিশ্বভারতীর কার্যক্রমের সংযোগ— এই ব্যতিক্রমী শিক্ষাভাবনা বিশ্বভারতীকে একটি অনন্য মর্যাদার আসন দিয়েছে। সে সব কর্মধারা বহু পূর্বেই গতি হারিয়েছে, এখন তাদের স্মৃতিও যেন মুছে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান থেকে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদকটিই কেবল হারায়নি, বিশ্বভারতীর চার পাশে কুশ্রী পাঁচিল উঠেছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে, তৈরি হয়েছে সন্দেহ এবং বিদ্বেষের আবহ। ছাত্রদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সংঘাত গড়িয়েছে আদালতে। শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের প্রতি কর্তাব্যক্তিদের সম্প্রীতির হাত ক্রমশ শাসনের তর্জনী হয়ে উঠেছে। গবেষণা, পঠন-পাঠনেও বিশ্বভারতীর স্থান গত কয় বছরে নিম্নগামী। আপন ঐতিহ্যের প্রতি অন্যমনস্কতা বিশ্বভারতীকে নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ছাতিমতলাকে অক্ষত রাখবার অক্ষমতা তাই আশ্চর্য নয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement