Law

প্রত্যাশা

গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক লুডউইগ উইটগেনস্টাইন অপ্রয়োজনীয় কথা বলার অভ্যাস ভয়ানক অপছন্দ করতেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২২ ০৪:৪৪
Share:

গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক লুডউইগ উইটগেনস্টাইন অপ্রয়োজনীয় কথা বলার অভ্যাস ভয়ানক অপছন্দ করতেন। এ কালের ভারতীয় সমাজে অতিকথনের বহর দেখে তিনি নিশ্চয়ই আশ্চর্য হয়ে ভাবতেন— যে কোনও বিষয়ে এত লোক অনর্গল এবং অহেতুক এত অবান্তর কথা বলে চলেছে, এ কি পাইকারি ব্রেক ফেল? তবে কিনা, সেই পরম মিতবাক দার্শনিকও হয়তো এ-ব্যাপারে আমজনতা এবং সমাজমাধ্যমের দিগ্‌গজদের ছাড় দিতেন। কিন্তু বিচারপতিরা? বিশেষত, তাঁরা যখন আদালতে আপন আসনে অধিষ্ঠিত? তখন তাঁদের উচ্চারণে কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণ জরুরি— ‌সচেতন নাগরিকমাত্রেই তা প্রত্যাশা করেন। গণতন্ত্রে বিচারবিভাগের স্থান অত্যন্ত বিশেষ এবং বিচারপতিরা পরম শ্রদ্ধেয়, তাই জন্যই এই প্রত্যাশা। এবং, সৌভাগ্যের কথা, বহু ক্ষেত্রেই মহামান্য বিচারপতিরা সেই প্রত্যাশা পূরণ করেন, তাঁদের প্রজ্ঞা ও সংযম নাগরিককে সমৃদ্ধ করে, সমাজকে সুষ্ঠু ভাবে চালিত করে। তাঁদের আচরণও তাঁদের ন্যায়বিচারকে স্বতন্ত্র মহিমা দেয়।

Advertisement

উদাহরণস্বরূপ, মনে করা যেতে পারে সম্প্রতি বিভিন্ন উপলক্ষে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বলিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, নির্ভীক এবং নীতিনিষ্ঠ বক্তব্যসমূহ। সব ক’টি ক্ষেত্রে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও ইতিমধ্যেই বিচারপতির বক্তব্য পশ্চিমবঙ্গের সমাজকে আশ্বস্ত করেছে যে, এই ঘনতমসাবৃত অনাচারের মধ্যেও আলোকরেখাটি সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয়নি— এখনও ভরসা আছে। তাঁর কাছে নাগরিকের প্রত্যাশা অনেক। তবে ঠিক সেই কারণেই আবার, তাঁর কোনও কোনও মন্তব্য শ্রোতাদের বিস্ময় উৎপাদন করেছে— যে বিস্ময় সুখকর নয়, বেদনাদায়ক। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত পর্বতপ্রমাণ অভিযোগের বিচার-প্রক্রিয়া উপলক্ষে ভূতপূর্ব শিক্ষামন্ত্রীর সম্পত্তির হিসাব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মাননীয় বিচারপতি বলেছেন: কখনও সুযোগ মিললে তিনি গান্ধী পরিবারের সম্পত্তির হিসাবও চাইবেন, জানতে চাইবেন রাহুল গান্ধীর সম্পদের উৎস কী, ওঁরা কোথা থেকে টাকা পান? বৈঠকি আড্ডাতেও বিচারপতির মুখে এমন মন্তব্য শোভন কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু আদালতের বিচারকক্ষে? এমন কথা কি আদৌ সম্মাননীয় বিচারপতির মুখে শোভা পায়?

প্রসঙ্গত, এক বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল, যে কথার অপব্যাখ্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, খোলা আদালতে তেমন অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের বিচারকদের সাবধান হওয়া দরকার। কেননা, “সংবিধানে হাই কোর্টকে বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত উচ্চস্তরের; হাই কোর্টের সতর্কতা ও বিচক্ষণতার মাত্রাটির সঙ্গে তাকে প্রদত্ত সেই ক্ষমতার চরিত্র এবং মাত্রার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে।” অর্থাৎ, এক কথায়, উচ্চ আদালতের আচরণ তার সাংবিধানিক ক্ষমতার মর্যাদার সঙ্গে মানানসই হওয়া দরকার। লক্ষণীয়, সুপ্রিম কোর্টের এই অনুজ্ঞাটি উচ্চারিত হয়েছিল নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মাদ্রাজ হাই কোর্টের তীব্র সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে— ২০২১ সালে কোভিড অতিমারির প্রবল সংক্রমণের জন্য হাই কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে ‘খুনের অভিযোগ দায়ের করা উচিত’ মন্তব্য করেছিল। এই ক্রোধের কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না, কিন্তু বিচারপতিদের কণ্ঠে ক্রোধের এমন প্রকাশ? এমন দৃষ্টান্ত এ দেশে ব্যতিক্রমী বা বিরল নয়। এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের ক্ষেত্রেও এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া সম্ভব। অথচ বিচারবিভাগের সম্মানরক্ষার্থেই বিচার্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বা সংশ্লিষ্ট বক্তব্য ছাড়া অন্য কোনও মন্তব্য থেকে বিরত থাকা শ্রেয়, জরুরিও। মহামান্য বিচারপতিদের কাছেই নাগরিক এই সব প্রশ্ন নিবেদন করতে পারেন— নাস্তি গতিরন্যথা।

Advertisement

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement