—ফাইল চিত্র।
সমস্যা যাহা ছিল, আছে। সমাধানও যাহা ছিল, তাহাই আছে। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশিত তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারটির সার কথা এই দুইটি বাক্যে বলিয়া দেওয়া চলে। গত দশ বৎসরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন উন্নয়নের একটি বিকল্প পথ রচনা করিতে সক্ষম হইয়াছে, এই কথাটি অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এই রাজ্যে বৃহৎ শিল্প নাই— অদূর ভবিষ্যতে আসিবে, তেমন ভরসাও নাই— কিন্তু, তাহাতে উন্নয়ন থামিয়া থাকে নাই। এমনকি, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পরিসংখ্যানও জানাইয়াছে যে, রাজ্যে মানব উন্নয়নের গতি অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় বেশি। এই বিকল্প পথটিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাধান, যেখানে সম্পদ পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রে সরকার বড় ভূমিকা পালন করিয়া থাকে। তাঁহার শাসনকালে চালু হওয়া বিবিধ ‘শ্রী’ এবং বিবিধ ‘সাথী’ এই কাজে সরকারের অস্ত্র।
ইস্তাহার বলিতেছে, মুখ্যমন্ত্রী সেই পথ হইতে সরেন নাই। আয়কর সীমার নিম্নে থাকা প্রতিটি পরিবারকে মাসে পাঁচশত টাকা অর্থসাহায্য করিবার প্রস্তাবটি সেই পথে একটি বড় পদক্ষেপ। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে নগদ হস্তান্তরের গুরুত্বের কথা অর্থশাস্ত্রীরা বহু দিন ধরিয়া বলিতেছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ইস্তাহারে ‘ন্যায়’ প্রকল্পটিও এই প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল। কিন্তু রাজ্যস্তরে এমন নগদ হস্তান্তরের প্রকল্প ভারতে সম্ভবত এই প্রথম। সামাজিক ক্ষেত্রে, কৃষিতে বা নারীর ক্ষমতায়নেও উন্নয়নের যে পথ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাছিয়াছেন, তাহা অব্যাহত রহিয়াছে। ‘দুয়ারে সরকার’ও চলিবে বলিয়া প্রতিশ্রুতি মিলিয়াছে। এত দিন বিনামূল্যে রেশন মিলিত— তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহার জানাইয়াছে, এই বার রেশনও মানুষের দরজায় পৌঁছাইয়া দেওয়া হইবে। অর্থাৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাধানসূত্রটি অপরিবর্তিত— সরকার এত দিন যাহা করিয়াছে, এই দফায় জিতিলে সেই কাজই আরও গুরুত্বের সহিত করা হইবে বলিয়াই প্রতিশ্রুতি মিলিয়াছে।
কিন্তু, রাজ্যের যে সমস্যা ছিল, তাহাও যে অপরিবর্তিতই থাকিবে, ইস্তাহারে সেই ইঙ্গিতও স্পষ্ট। সমস্যা হইল, রাজ্যে শিল্প নাই। তাহার ফলে, রাজ্যে আয়ের পরিমাণ কম। মানুষের হাতেও টাকা নাই, সরকারের হাতেও নাই। সেই সমস্যা দূর করিবার কোনও দিগ্নির্দেশ এই ইস্তাহারে নাই। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের পথে বৃহত্তম বাধা হইল জমি। এবং, সেই জমি-রাজনীতিই যে হেতু তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভিত্তি, ফলে রাজ্যের ভবিষ্যৎও শিল্পহীন থাকিবে বলিয়াই আশঙ্কা। গত দশ বৎসরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝাইয়া দিয়াছেন, কোনও প্রয়োজনেই তাঁহারা কৃষিজমি অধিগ্রহণ করিতে তেমন আগ্রহী বা সচেষ্ট হইবেন না। তাহার ফলে রাজ্যে একটি নিম্নস্তরের স্থিতাবস্থা জাঁকাইয়া বসিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিতে হইবে, তাঁহার মডেলের উন্নয়ন চালাইয়া যাইতে হইলেও টাকা প্রয়োজন— শূন্য ভাঁড়ার হইতে বণ্টন করা যায় না। তিনি যদি ট্রিকল ডাউন মডেল, অর্থাৎ শিল্পায়নের ফলে চুয়াইয়া পড়া সমৃদ্ধির পথটিতে বিশ্বাসী না হন, তাহাতে সমস্যা নাই— তিনি চাহিলে সরকারই সেই সমৃদ্ধির পুনর্বণ্টনের দায়িত্ব লইতে পারে। কিন্তু, তাহাতে সমৃদ্ধি অর্জনের গুরুত্ব খাটো হইয়া যায় না। তাঁহার রাজনৈতিক বোধ প্রখর, এবং সেই রাজনীতির মাধ্যমে যে সামাজিক স্থিতাবস্থায় পৌঁছানো যায়, তিনি তাহাতে পৌঁছাইতে সক্ষম হইয়াছেন। এই বার, চালকের আসনে অর্থনীতির বসা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ কী হইবে, সেই সিদ্ধান্তটি যাহাতে অর্থশাস্ত্রের যুক্তি দ্বারা গৃহীত হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। তাঁহার সমাধান সূত্রগুলি অপরিবর্তিত থাকুক, কিন্তু রাজ্যের আদি সমস্যাটিকে ভিন্নতর অস্ত্রের দ্বারা আঘাত করা জরুরি।