ভারতীয় জাতীয় দলের বাঙালি উইকেটরক্ষক-ব্যাটার ঋদ্ধিমান সাহাকে ভাগ্যহত বলিলে ভুল হইবে না। একাধিক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ বারংবার তাঁহার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়াছেন, ভারতীয় ক্রিকেট দলের ভূতপূর্ব কোচ রবি শাস্ত্রী তাঁহাকে ‘বর্তমান বিশ্বসেরা’ বা ‘সর্বকালের অন্যতম সেরা’ বলিয়াও বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু জাতীয় মঞ্চে তাঁহার আবির্ভাব ২০১০ সালে— মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তখন মধ্যগগনে। জাতীয় দলে ঋদ্ধিমানের সুযোগ মিলে নাই। তিনি ধোনি অপেক্ষা বড় উইকেটরক্ষক কি না, সেই প্রশ্নটি ঢাকা পড়িয়া গিয়াছিল অন্য দুইটি সত্যের সম্মুখে— এক, ধোনি ব্যাটার হিসাবে উচ্চমানের, এবং দুই, অধিনায়ক হিসাবে ধুরন্ধর। একবিংশ শতকের ক্রিকেট-বিশ্বে উইকেটরক্ষকের ব্যাটিং প্রতিভার অধিকতর গুরুত্বের মাপকাঠিতে ঋদ্ধিমান উত্তীর্ণ হন নাই।
২০১৪ সালে টেস্ট ক্রিকেট হইতে ধোনির আচমকা অবসর ঘোষণার পরে ঋদ্ধিমান দলে সুযোগ পাইয়াছিলেন। কিপিংয়ে তো বটেই, ব্যাটিংয়েও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ় বা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শতরানও করেন তিনি। তৎসত্ত্বেও যখন তাঁহাকে দলে নেওয়া হয় না, এবং কার্যত ‘বাতিল’ বলিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হয়, তখন প্রশ্ন উঠিত পারে, তাঁহার প্রতি কি অবিচার হইল না? কেহ বলিতে পারেন যে, ঋদ্ধিমান আপনার ঢাক পিটাইতে অভ্যস্ত নহেন, কর্তাদের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠতা নাই, ক্রিকেট জগতেও কোনও ‘পৃষ্ঠপোষক’ নাই— সেই কারণেই বহুবিধ অবিচার তাঁহার ভাগ্যে জুটিয়াছে। তবে, ইতিহাস সাক্ষ্য দিবে যে, খেলার ধর্মের প্রতি ঋদ্ধিমান অবিচার করেন নাই। নিজের আর সুযোগ নাই বুঝিয়াও যথার্থ টিমম্যানের ন্যায় উত্তরসূরি ঋষভ পন্থকে ক্রমাগত সাহায্য করিয়া গিয়াছেন তিনি। ক্রীড়াদেবতার আশীর্বাদ যে তাঁহাকে ছাড়িয়া যায় নাই, আইপিএল-এর বর্তমান নিলাম তাহার প্রমাণ।
প্রশ্নটি অবশ্য শুধু ব্যক্তি ঋদ্ধিমানকে লইয়া নহে। প্রশ্ন হইল, এক জন খেলোয়াড়ের সাফল্যের জন্য কি তাঁহার প্রতিভা, নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমই যথেষ্ট? না কি, তিনি কোন প্রতিবেশ হইতে উঠিয়া আসিতেছেন, প্রস্তুতির কতখানি সুযোগ তাঁহার ছিল, তাঁহার সামাজিক সংযোগ কোন গোত্রের, এই বিবেচনাগুলির উপরই প্রতিভার মূল্য নির্ভর করে? বস্তুত, প্রশ্নটির পরিসরকে আরও বিস্তৃত করিয়া লওয়া যায়— সাফল্যের পশ্চাতে ব্যক্তির নিজস্ব অবদান কতখানি, আর পরিপার্শ্বের ভূমিকা কয় আনা? প্রশ্নটি সোশ্যাল মোবিলিটি বা সামাজিক চলমানতার। ইহা অনস্বীকার্য যে, বিশেষত ভারতের ন্যায় দেশে যে কতিপয় ক্ষেত্রে সামাজিক চলমানতার মাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি, ক্রীড়া তাহার মধ্যে একটি। রাঁচির ন্যায় ছোট শহরের এক অকিঞ্চিৎকর পরিবার হইতেই উঠিয়া আসিয়াছিলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। কিন্তু, তাঁহার উত্থানেও নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রশ্ন হইল, যেখানে শ্রেষ্ঠ প্রতিভাকে সুযোগ দিলে দেশের, বা সমাজের লাভ, সেখানে সেই প্রতিভার উত্থানের দায়িত্বটি কি সম্পূর্ণত ব্যক্তির উপর ছাড়িয়া দেওয়া চলে? ফসল পাকিবার পর তাহা গোলায় তোলাই কি দেশের একমাত্র কর্তব্য, না কি তাহাকে লালনপালনের দায়িত্বটিও অনস্বীকার্য? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান না করিলে কতখানি ক্ষতি, সেই হিসাবটি কষাও বিধেয়।