বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি হল ইষ্ট এবং অভীষ্ট, কলা বিষয়গুলি নিতান্ত এলেবেলে— এমন একটি ধারণা ভারতীয় সমাজে প্রবল। ভারতের বাইরেও এই ধারণা কম প্রবল নয়। এই ধারণার প্রচার ও প্রসারের প্রধান কারণটি বিশ্ব ধনতান্ত্রিক বন্দোবস্তের মধ্যে সরাসরি প্রোথিত। কোন বিষয় পড়লে চাকরি মেলে তাড়াতাড়ি, টাকা পাওয়া যায় বেশি, এতেই বিষয়ের মূল্য ধার্য হয়। আর চাকরির সংখ্যা এবং টাকার অঙ্ক যে নির্ভর করে ধনব্যবস্থার অঙ্গুলিসঙ্কেতে, সে কথা কে না জানে! সম্প্রতি যেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ‘বনাম’ কলা ধারণাটি আরও শক্তপোক্ত হয়েছে। কোভিড অতিমারিই কি তার কারণ? গোটা বিশ্বব্যাপী মারণ ভাইরাসের দাপট দেখে কি মনে হতে শুরু করেছে যে, মারে বিজ্ঞান রাখে কে, কিংবা রাখে বিজ্ঞান মারে কে? কথাটা কিন্তু পুরো ঠিক নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যদি এমন ভাবে প্রচারিত হতে থাকে, যাতে কলাজগৎ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়, তা হলে যে কত বড় বিপদ, তা ভাল করে বোঝা দরকার। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা নিজেরা বুঝতে পারলে তবেই বাকি সমাজকে তাঁরা তা বোঝাতে পারবেন।
কলা বিষয়ের প্রধান গুরুত্বটি কী? সমাজ ও মানুষের চরিত্র বুঝতে তা আমাদের সাহায্য করে। কী ভাবে সেই চরিত্র পাল্টায়, কত রকম তার বৈচিত্র বা বৈশিষ্ট্য, এ সব জানা যায় ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, মনোবিদ্যা, এমনকি সাহিত্যের মাধ্যমেই। অর্থনীতি বিষয়টি ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান ও কলা জগতের মধ্যেকার আলো-আঁধারি জগতে প্রবেশের ‘সৌভাগ্য’ অর্জন করেছে, সুতরাং তার কথা বাদ থাকল। কেবল এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, অর্থনীতি বিষয়টি যে ইতিহাস কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে কতটা ওতপ্রোত সংযুক্ত, এতই যে এককে ছাড়া অন্যকে বোঝা যায় না— সে কথা পড়ুয়াজগতের বাইরের মানুষরা খেয়ালই করেন না, আর পড়ুয়ারা অনেক সময় ভুলে গিয়ে অনর্থ বাধাতেই প্রবৃত্ত হন। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানুষ ও সমাজের যুগ্ম ছবি অসম্ভব জরুরি হয়ে পড়ে, কেননা প্রযুক্তি আসলে মানুষেরই ব্যবহার্য, মানুষের প্রয়োজনপূরণই তার অভীষ্ট— মানবচরিত্র ও তার প্রয়োজনের নকশা না জানলে প্রযুক্তি সম্পূর্ণত হীনবল।
কিছুটা একই কথা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও খাটে। আশ্চর্য নয় যে, বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের সাহিত্যপ্রেম আজও স্মরণীয়, তাঁদের সমাজ ও ইতিহাসের বোধ আজও আমাদের পথপ্রদর্শক। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই— মহেন্দ্রলাল সরকার, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, হোমি ভাবাদের কথা ভাবলেই বোঝা যায় সামাজিক ও মানবিক চিন্তা কতটাই তাঁদের ভাবনাজগতের মধ্যে প্রবিষ্ট ছিল। দেশ ও জাতি নিয়ে তাঁদের বক্তব্য ও স্বপ্ন কত স্পষ্ট ছিল। প্রথম সারির চিন্তাবিদ ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকে। আজ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যে ছাত্রছাত্রীরা কলা বিষয়গুলিকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করে ‘পণ্ডিত’ হয়ে উঠছে, ভবিষ্যতে তারা এমন জায়গায় পৌঁছতে পারবে কি? যদি না পৌঁছয়, তবে কি দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে? বিজ্ঞান যদি পরীক্ষাগারে বদ্ধ থাকে, প্রযুক্তি যদি মানুষ-পরিহারী যন্ত্রবিদ্যায় পরিণত হয়— তবে মানুষের শেষ অবধি কত লাভ কত ক্ষতি, তা হিসাব করার সময় এসেছে।