West Bengal

খিদের হিসাব

আজ কি বাংলার মানুষ গ্রাসাচ্ছাদনের খরচ মেটানোর ক্ষমতা হারিয়েছে? এই সম্ভাবনা তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২২ ০৫:১৯
Share:

ফের কি খিদের কালো ছায়া ঘনিয়ে এল বাংলায়? এক অসরকারি সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গে অনাহার, অর্ধাহারের যে চিত্র ধরা পড়েছে, তা উদ্বেগজনক। গত বছর ডিসেম্বর থেকে এ বছর জানুয়ারি, এই সময়ে ষোলোটি জেলার প্রায় দু’হাজার পরিবারের থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রতি দশ জনে প্রায় সাত জন (৬৯ শতাংশ) অন্তত একটা সম্পূর্ণ দিন অনাহারে কাটিয়েছেন, অর্ধেকেরও বেশি (৫৩ শতাংশ) এক বেলা অভুক্ত থেকেছেন। খিদে থাকা সত্ত্বেও খাননি, এমন মানুষের সংখ্যা দশ জনে প্রায় ছ’জন। তীব্র খাদ্যসঙ্কটের এই ছবি আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। গত বছর ধানচাষের এলাকা বেড়েছে, কাজ হারিয়ে বাড়ি ফেরা কর্মহীন মানুষ কৃষির দিকেই ঝুঁকেছেন। ফলে কেবল খরিফ মরসুমে ১ কোটি ৭৩ লক্ষ টন ধান উৎপন্ন হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে; কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় যা ‘রেকর্ড’ বলে দাবি করেছেন এ বছর তাঁর বাজেট-বক্তৃতায়। উৎপাদনের এই প্রাচুর্যের মধ্যে খাদ্যাভাব দেখা দেয় কী করে? দ্বিতীয়ত, কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকারই রেশনের মাধ্যমে বিনামূল্যে চাল-গম বিতরণের প্রকল্প চালিয়েছে গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। তবুও রাজ্যে কেন এত খিদে? এর উত্তর অনুসন্ধানসাপেক্ষ, কিন্তু বাংলারই অতীত সাক্ষ্য দেয় যে, শস্যের ফলন যথেষ্ট হলেও, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আশি বছর আগে বাংলার ভয়ানক মন্বন্তর শস্যের অভাবে হয়নি, হয়েছিল চালের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য।

Advertisement

আজ কি বাংলার মানুষ গ্রাসাচ্ছাদনের খরচ মেটানোর ক্ষমতা হারিয়েছে? এই সম্ভাবনা তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। অতিমারিতে কর্মহীনতা বেড়েছে, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে। বেকারত্বের সুযোগে মজুরি কমেছে বহু ধরনের কাজে। তার উপর দ্রুত বেড়েছে নানা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের দাম। বিশেষত জ্বালানি, ভোজ্য তেল ও ওষুধের দামে বৃদ্ধি বিপন্নতা বাড়িয়েছে। দরিদ্র যে অত্যাবশ্যক পণ্যগুলিতেও ব্যয় কমাচ্ছে, তার ইঙ্গিত অতিমারির আগেই মিলেছিল। এখন খাবার কিনতেও টাকায় টান পড়ছে। একই সঙ্গে, জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলি নিয়ে রাজনীতির বাগাড়ম্বর বাড়ছে, অথচ সেগুলি মূল্যায়নের উদ্যোগ কমছে। রেশন দুয়ারে পৌঁছলেও তা গৃহস্থের প্রয়োজনের কতটুকু মেটাতে পারছে, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প বা মিড-ডে মিল শিশুপুষ্টির প্রয়োজনের কতটুকু বাস্তবিক জোগাচ্ছে, তার হিসাব দাখিল করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নারাজ। তার উপর একশো দিনের কাজের প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ। বকেয়া মজুরির অঙ্ক ১৬০০ কোটি টাকা, এ বছর কাজও মিলছে না। খাদ্যসঙ্কট এড়াতে ঋণ করছে গ্রামীণ পরিবারগুলো, এই সমীক্ষায় তার ইঙ্গিত মিলেছে।

নাগরিক উদ্যোগে উঠে আসা এই সব টুকরো ছবি এক মস্ত বিপন্নতার আভাস। প্রকৃত পরিস্থিতি স্পষ্ট করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা সরকারি মঞ্চ থেকে ক্রমাগত শাসক দলের ‘সাফল্য’ প্রচার করে চলেছেন। রাজ্যের ভাবমূর্তি ‘উজ্জ্বল’ করাই তাঁদের মতে সংবাদমাধ্যম তথা নাগরিক সমাজের কাজ। ক্ষুধার অন্ধকার, সরকারি প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা, বাজারের বিবিধ অন্যায্যতা ও প্রশাসনিক নীতির ব্যর্থতা নিয়ে অনুসন্ধানের অনুরোধ করলেও সরকার ক্রুদ্ধ হয়। আশি বছর আগে ব্রিটিশ সরকার বাংলার মন্বন্তর গোপন করতে সংবাদমাধ্যমে ‘দুর্ভিক্ষ’ কথাটির উল্লেখ নিষিদ্ধ করেছিল। আজও অনাহার, অর্ধাহার, অপুষ্টি, খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির উল্লেখ অসহনীয় স্পর্ধা বলে দেখা হয়। কঠোর বাস্তবকে মুখের কথায় বাতিল করতে বড়-মেজো নেতাদের জুড়ি নেই। তাঁদের দেওয়া পরিসংখ্যানে গরিবের পেট ভরে না, এই যা মুশকিল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement