—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশন উপলক্ষে সংসদে রাষ্ট্রপতির উদ্বোধনী ভাষণের উপর প্রথম বিতর্কটি ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে, সংসদীয় বিতর্ক আবার তার সত্যরূপ খুঁজে পাবে, জন স্টুয়ার্ট মিল তথা ওয়াল্টার ব্যাজ কথিত ‘আলোচনা-নির্ভর সুশাসন’ প্রতিষ্ঠিত হবে— এমন স্বপ্ন কেউ দেখেননি। তবে গত নির্বাচনের জনাদেশে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক চেতনার যে প্রতিফলন ঘটেছে, তাকে সম্মান জানিয়ে নবনির্বাচিত আইনসভার সদস্যরা নতুন সংসদ ভবনে পারস্পরিক মতামত বিনিময়ের অনুশীলনে অন্তত কিছুটা সংযম এবং সৌজন্যের পরিচয় দেবেন, এই প্রত্যাশাটুকু অসঙ্গত ছিল না। কিন্তু প্রথম অধিবেশনের পাট চুকলে দেখা গেল, সংসদ সেই পরিচিত তিক্ততার সাধনায় একনিষ্ঠ, অবিচল, অক্লান্ত। শাসক এবং বিরোধী শিবিরের রথী মহারথী থেকে শুরু করে তাঁদের নানা মাপের সৈন্যসামন্তরা পরস্পরের উদ্দেশে কেবলই আক্রমণ শাণিয়ে গেলেন, তাঁদের বিপুল কলরোলের সারমর্ম একটিই: আমরা ভাল লক্ষ্মী সবাই তোমরা ভারী বিশ্রী। আরও এক বার দেখা গেল, মহামান্য জনপ্রতিনিধিবৃন্দ বাগ্যুদ্ধ শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে রণহুঙ্কারে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর।
এই প্রারম্ভিক দ্বৈরথকে নিছক গতানুগতিকতা মনে করলে কিন্তু ভুল হবে। সংসদীয় রীতিনীতি বা সভ্যতার আদর্শ আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সেই জল্পনা সরিয়ে রেখে বাস্তব পরিস্থিতির দিকে চোখ ফেরালে একটি সত্য প্রকট হয়ে ওঠে। পরিবর্তনের সত্য। নরেন্দ্র মোদী শাসিত ভারতের সংসদে এই প্রথম একতরফা দাপটের বদলে দেখা গেল ধুন্ধুমার লড়াইয়ের চলৎ-চিত্র। বিশেষত, আনুষ্ঠানিক ভাবে বিরোধী দলনেতার আসনে অধিষ্ঠিত রাহুল গান্ধীর প্রবল, আপসহীন এবং অভিনব সওয়ালের সামনে শাসক শিবিরকে স্পষ্টতই কেবল বিস্মিত নয়, হতচকিত দেখিয়েছে। সেই প্রাথমিক অভিঘাত সামলে সপারিষদ প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাঘাতে প্রবৃত্ত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাতে বড় ছবিটি ঢাকা পড়েনি। বড় ছবি এই যে, নরেন্দ্র মোদী এত কাল নিজের চার পাশে যে স্বাতন্ত্র্যের বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছেন সেটি ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, তিনি নিজেই তাঁর কথায় এবং দেহভঙ্গিতে ফাঁস করে দিয়েছেন যে তিনি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে একই সমতলে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন, লড়াই করতে বাধ্য হয়েছেন। নিন্দকেরা যদি একে ‘পরমাত্মার মর্তে অবতরণ’ বলে অভিহিত করেন, দোষ দেওয়া যাবে কি?
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে: তাঁর নতুন কিছু বলার নেই। হিন্দুত্বের ফানুসটি আপাতত ফুটো হয়েছে, ভবিষ্যতে তার নবপ্রতিমা নির্মাণ করা যাবে কি না সেই বিষয়েও ঘোর সংশয়। এখন তাঁকে বিশল্যকরণীর সন্ধানে বিস্তর পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু বিরোধী নায়কনায়িকারা যদি মনে করে থাকেন তাঁদের কাজ শেষ হয়েছে, অতঃপর শাসকের ছিদ্রান্বেষণেই সিদ্ধিলাভ হবে, তা হলে মস্ত ভুল হবে। রাহুল গান্ধী সংসদে শিবজি-র ছবি দেখিয়ে হিন্দুত্ব বনাম হিন্দুধর্মের খেলায় প্রতিপক্ষকে বেসামাল করে থাকতে পারেন, কিন্তু দ্রুত, অতি দ্রুত তাঁকে এবং তাঁর সহযোগীদের নিজের খেলা তৈরি করতে হবে। খেলা নয়, তার নাম যথার্থ রাজনীতি। সেই রাজনীতির লক্ষ্য হবে একটি উদার, সহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সর্বজনীন উন্নয়নের প্রকল্প রচনা করা। অচ্ছে দিন বা অমৃত কালের ব্যর্থ রসিকতা নয়, যথার্থ উত্তরণের প্রকল্প। শাসকের অনাচারের প্রতিবাদ অবশ্যই জরুরি, সঙ্কীর্ণ স্বার্থের ছলনায় বিভ্রান্ত না হয়ে সেই প্রতিবাদে সঙ্ঘবদ্ধ থাকা আরও জরুরি, কিন্তু ইতিবাচক বিকল্প রচনার কাজটি একটুও কম জরুরি নয়। সেটাই তাঁদের কাছে ভারতীয় গণতন্ত্রের দাবি। সে-কাজ তাঁরা কিন্তু এখনও শুরুই করেননি। আসন্ন বাজেট অধিবেশনে যদি সেই ঘাটতি না মেটে, জনপথ রাজপথের শোরগোলই যদি সংসদকে গ্রাস করে রাখে, তবে ক্ষীণ আলোকরেখাটুকু অচিরেই বিলীন হবে।