হরিদ্বারে গঙ্গায় পদক বিসর্জন দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন কুস্তিগিরেরা। ছবি: পিটিআই।
এখন দেশ জুড়ে তর্কাতর্কি ও প্রতিবাদ চলছে, কুস্তির আখড়ায় ওস্তাদ ক্রীড়া-কৌশল শেখাতে গিয়ে মহিলা কুস্তিগিরদের সম্মান হানি হয়েছে কি না, তা নিয়ে। লক্ষণীয়, অভিযোগকারীদের কথা শুনে অভিযুক্তের পদমর্যাদা হ্রাস করা হয়নি। বরং এ কথাও কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন সংবেদনশীল এই বিষয়টি এ ভাবে প্রকাশ্যে আসায় বিশ্বমঞ্চে ভারতের সম্মানহানি হচ্ছে। দেশের সম্মানের কথা মাথায় রেখেই বিষয়টি নিয়ে এ ভাবে প্রতিবাদী গোলযোগ করা নাকি বিধেয় নয়। যুক্তিটি অতি পুরাতন ও সারবত্তাহীন। পরিবারের নামে, রাজ্যের নামে, দেশের নামে এ ভাবে সত্যের দিকে যেতে না দেওয়ার কৌশলী পদ্ধতি সব সময়েই শাসকেরা গ্রহণ করেন। গ্রিক নাটক থেকে শুরু করে ইংরেজ উপনিবেশ সর্বত্রই এমন উদাহরণ রয়েছে। রাজা ক্রেয়ন আদেশ দিয়েছিলেন এতোয়ক্লেস্ দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন বলে পরম গৌরবে তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হবে। পলুনেকেস্ রাজপুত্র ও থিবসের সন্তান কিন্তু যে-হেতু তিনি এ ক্ষেত্রে ক্রেয়নের মতাবলম্বী নন, সে-হেতু দেশদ্রোহী। তাঁর দেহ সম্মানযোগ্য নয়, শকুন-কুকুরে সে দেহ ছিন্নভিন্ন করুক। আন্তিগোনে এর প্রতিবাদ করেন। তাই নিয়েই সোফোক্লেস নাটক লিখেছেন। মৃতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মানবিক নীতি বড়, না কি ক্ষমতাসীন রাজার পন্থাবলম্বনকারীর ‘দেশানুরাগ’ বড়?
ইংরেজ উপনিবেশে পিয়ার্সন তাঁর ফর ইন্ডিয়া বইতে শাসকের একচোখো নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। রাশিয়ায় স্বাধীনতাকামীদের পক্ষে কথা বলছেন ইংরেজ শাসক। অথচ তাঁরাই আয়ারল্যান্ড, মিশর, ভারতবর্ষ এই তিন দেশে স্বাধীনতার গলা টিপে ধরছেন। পিয়ার্সন ইংরেজ হয়েও কী ভাবে ইংরেজ বিরোধিতা করছেন, দেশের সম্মানহানি করছেন সে বিষয়ে ইংরেজ শাসকেরা বিস্মিত। কেবল বিস্মিতই নন দেশবিরোধী কার্যকলাপের জন্য তাঁকে চিন থেকে বন্দি করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয় ইংরেজ-পুলিশ। সেই একই যুক্তি ও পদ্ধতি ব্রিজভূষণবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এখন চোখে পড়ছে। পদ্ধতিটি স্বৈরতান্ত্রিক ও সত্যনীতির বিরোধী সন্দেহ নেই। ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’-এর ধুয়ো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য থেকে আমাদের বঞ্চিত করছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সত্য’ প্রবন্ধে খুবই গভীর একটি কথা লিখেছিলেন। “আমাদের আত্মানুরাগ, দেশানুরাগ, লোকানুরাগ অনেক সময়ে আমাদিগকে সত্যভ্রষ্ট করিতে চেষ্টা করিতে থাকে; এইজন্যই সত্যানুরাগকে এই-সকল অনুরাগের উপরে শিরোধার্য করা আবশ্যক।” কথাটি কেবল গভীর নয়, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক কালে রাজনীতির কারবারিরা সর্বার্থেই সত্যানুরাগ বঞ্চিত। তাঁরা আত্মানুরাগ, দেশানুরাগ, লোকানুরাগের দোহাই দিয়ে সত্য থেকে দূরে চলে যান। এই চলে যাওয়া নিজেদের সুবিধার্থে। দলের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই আচরণ। কেন্দ্রীয় সরকার দেশানুরাগের দোহাই দিয়ে প্রকৃত সত্যকে বাইরে আসতে দেন না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়তো ভাল নয়— পরিসংখ্যানের সুবিধামতো প্রয়োগে সেই সত্য বিশ্বের দরবারে ও দেশের দরবারে চাপা দেওয়া হল। ফ্যাসিস্ট শক্তি তা-ই করে। রবীন্দ্রনাথকে মুসোলিনি ইটালির সেই দিকটিই দ্রুততার সঙ্গে দেখিয়েছিলেন যে দিকটি দেখালে রবীন্দ্রনাথ খুশি হবেন। এখন বিষয়টি জটিলতর। প্রযুক্তির কল্যাণে ও কৌশলে ইচ্ছেমতো সত্য প্রদর্শনের কত উপায়। ভুল ছবি ও মিথ্যে ছবি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে হয়কে নয় ও নয়কে হয় করে তোলা হচ্ছে। তবে ভরসার কথা, এই কোনও মহিমাই চিরায়ত নয়। দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে দেশের মানুষকে কিছু দিন হয়তো মিথ্যে স্বপ্ন সরবরাহ করা সম্ভব, দীর্ঘ দিন এই ভুল স্বর্গের স্বপ্নে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠকে মজিয়ে রাখা অসম্ভব। তবে তার জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণেরও বিশেষ ভূমিকা থাকা দরকার। রবীন্দ্রনাথ সত্য বলতে আত্মোপলব্ধির কথা বুঝতেন। দেশের সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে দেশ বলতে কোনও রাজনৈতিক ফেরিওয়ালার উচ্চনাদী বক্তৃতা নির্মিত ছবিকে বোঝায় না। দেশ বলতে চার পাশে খোলাচোখে যা দেখা যাচ্ছে তাকেই বোঝায়। সেই চার পাশের বাস্তবকে দেখে, জেনে কী হলে ভাল হয় সে বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিমত নির্মাণ করতে পারলেই কিন্তু গণতন্ত্রের মঙ্গল। কুস্তির আখড়ায় দেশবাসী নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। প্রত্যেকের নিজস্ব কুস্তিমঞ্চে সত্যের জন্য লড়াই করলে এই ভুল স্বর্গের অবসান হবে। এই গণতন্ত্রে কেউই বিচারের ঊর্ধ্বে নয়, কোনও কিছুর দোহাই দিয়ে সত্য বিচার আটকানো যাবে না।