সঙ্ঘ পরিবার ‘ঘর ওয়াপসি’ না করলে ভারতের জনজাতিভুক্ত মানুষরা ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে যেতেন, এমন কথা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতকে বলেছিলেন কি না, যাচাইয়ের উপায় নেই। প্রয়োজনও নেই। কারণ, কথাটির ‘উদ্ধৃতি’ দেওয়ার সময় ভাগবত প্রণব মুখোপাধ্যায়কে একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছিলেন মাত্র। দিনকয়েক আগেই কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, রাজঘাটে প্রণববাবুর স্মারকস্থলের জন্য জায়গা বরাদ্দ হয়েছে। নেহরু-গান্ধী পরিবার-বহির্ভূত কংগ্রেস নেতা, অতএব তাঁকে ‘সম্মান’ জানানোর মাধ্যমে কংগ্রেসের ঐতিহ্য থেকে তাঁকে বিচ্যুত করার কাজও হয়ে যায়। এবং, তাঁর ‘উক্তি’ ব্যবহার করে দেখানো যায় যে, জনজাতি গোষ্ঠীর প্রতি নেহরু-গান্ধী পরিবারের অবস্থানের চেয়ে প্রণববাবু সঙ্ঘের ধর্মান্তরণের রাজনীতিকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করতেন। অর্থাৎ, পরিবার-বহির্ভূত কংগ্রেসও প্রকৃত প্রস্তাবে এই রাজনীতিতেই বিশ্বাসী। এই মুহূর্তে কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যে ক’টি রাজ্যে কংগ্রেসের জোট রাজনীতি সফল, ঝাড়খণ্ড তার অন্যতম। সেখানে বিজেপি লোকসভা ও বিধানসভা, কোনও নির্বাচনেই তেমন দাঁত ফোটাতে পারেনি। রাজ্যে কংগ্রেসের শরিক ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা স্বাভাবিক কারণেই সঙ্ঘের ‘ঘর ওয়াপসি’-র রাজনীতির ঘোর বিরোধী। ফলে, প্রণববাবুকে জড়িয়ে এই মন্তব্যকে কংগ্রেস ও জেএমএম-এর মধ্যে ফাটল তৈরির প্রয়াস হিসাবে দেখলে তাকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বলা মুশকিল।
ভারতে সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হওয়ার পর থেকেই আরএসএস জনজাতি গোষ্ঠীগুলির কাছে যাওয়ার বিষয়ে সচেতন এবং সচেষ্ট। অবশ্য, সেই জনগোষ্ঠীগুলিকে ‘জনজাতি’ বা ‘আদিবাসী’ বলতে সঙ্ঘ নারাজ— তাদের ভাষায় এঁরা ‘বনবাসী’। ১৯৫০-এর দশকের প্রথমার্ধেই বর্তমান ছত্তীসগঢ়ের যশপুর অঞ্চলে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় সঙ্ঘের শাখা সংগঠন বনবাসী কল্যাণ আশ্রম। ক্রমে সেই সংগঠন ভারতের জনজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে বিস্তার লাভ করে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বহু জনজাতি অঞ্চলে বিশেষত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কাজে এই আশ্রমের ভূমিকা অকিঞ্চিৎকর নয়। এবং, প্রথাগত ভাবে বর্ণহিন্দুদের অধিকারভুক্ত, এমন বেশ কিছু জিনিস সঙ্ঘ সচেতন ভাবে জনজাতিভুক্ত মানুষের আওতায় এনেছে। বর্তমান জমানায় বীরসা মুন্ডার জন্মদিন ঘোষিত হয়েছে জনজাতীয় গৌরব দিবস হিসাবে। একে অবশ্য অবিমিশ্র মানবপ্রেমের উদাহরণ ভাবলে ভুল হবে। জনজাতিভুক্ত মানুষকে ‘বৃহৎ হিন্দুত্ব’-এর ছত্রছায়ায় আনার চেষ্টার পাশাপাশি চলেছে তাঁদের ধর্মান্তরণ রোখার কাজ। সে কাজ যে সর্বদা শান্তিপূর্ণ পথে হয়নি, ইতিহাস তারও সাক্ষ্য বহন করছে।
সঙ্ঘ পরিবার জনজাতিভুক্ত মানুষকে কী চোখে দেখে, ভাগবতের বর্তমান মন্তব্যটিকে কেউ তার প্রমাণ বলতে পারেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় কথাটি বলেছিলেন কি না, সে প্রশ্ন অবান্তর— ভাগবত যখন জনসমক্ষে কথাটি বলেছেন, তখন কথাটি তাঁর(ও)। কথাটির একটি ঔপনিবেশিক ভিত্তি আছে। ১৮৭১ সালে তৎকালীন ঔপনিবেশিক সরকার ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট এনে প্রায় দু’শো জনজাতির মানুষকে ‘জন্মসূত্রে অপরাধী’ হিসাবে দাগিয়ে দেয়। সেই আইনের পিছনে যেমন জনজাতি বিদ্রোহের ফলে শাসকদের নাস্তানাবুদ হওয়া ছিল, তেমনই ছিল তৎকালীন বর্ণহিন্দু সমাজের জনজাতিভুক্ত মানুষের প্রতি ঘৃণার সার্বিক আবহ। জনজাতিদের ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে যাওয়ার ‘সম্ভাবনা’ উল্লেখ করে ভাগবত বুঝিয়ে দিলেন, ক্যালেন্ডারের পাতাই পাল্টেছে শুধু, বর্ণহিন্দু মন পাল্টায়নি। রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘অপর’ হিসাবে দাগিয়ে দিতে হিন্দুত্ববাদীরা যে ভাষ্য ব্যবহার করেন, জনজাতিদের ক্ষেত্রে অবিকল সেই ভাষার প্রয়োগ এই ‘অপরায়ণ’-এর অন্তর্নিহিত প্রবণতাটিকেই স্পষ্ট করে দেয়। ভোট চাওয়ার সময় ‘ভাই’ বলে ডাকার ভান যে নেহাতই রাজনৈতিক, তাতে আর সংশয় থাকে না।