একটি চিত্র সহস্র কথার সমান, তাহা ফের বুঝাইল বানভাসি গ্রামে পোলিয়ো টিকাকরণের ছবি। কোমরজল, গলাজলে দাঁড়াইয়া স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা খাওয়াইতেছেন, নবজাতক সন্তানকে হাঁড়িতে ভাসাইয়া আনিয়াছেন পিতা— এই দৃশ্যগুলি অপরূপ আশ্বাসে মন ভরাইয়া তুলে। রাষ্ট্রশক্তিতে বলীয়ান নেতা-আধিকারিকদের একটি বড় অংশের সীমাহীন স্বার্থান্বেষণ যখন সমাজধর্ম তথা মানবিকতার স্বরূপটি ভুলাইতে উদ্যত, তখন তৃণমূল স্তরের কর্মীরা আপন দৃষ্টান্ত দ্বারা সে আস্থা ফিরাইয়া আনিলেন। নিজের নির্দিষ্ট কর্তব্যটি পালন করিবার জন্য যে সাহস ও স্বার্থত্যাগের প্রয়োজন হয়, তাহাই কি দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ নহে? গণতন্ত্রে নাগরিকত্বের শর্ত পূর্ণ করিবার প্রথম ও প্রধান শর্ত— কর্তব্যপালন। আপন কাজের গুরুত্ব এই কর্মীরা বুঝিয়াছেন— ‘পালস পোলিয়ো’ দিবসগুলিতে সকল শিশুকে প্রতিষেধক না দিলে কোনও না কোনও শরীর আশ্রয় করিয়া রোগের ভাইরাস বাঁচিয়া থাকিবে, তাহা হইতে ফের সংক্রমণ ছড়াইবে। পোলিয়ো রোগটি নির্মূল করিবার উপায়, সকল শিশুর টিকাকরণ। একটিও অরক্ষিত শিশু থাকিবার অর্থ, সকল শিশুর ঝুঁকি। তাই প্রবল দুর্যোগেও আপন প্রাণের ঝুঁকি লইয়া স্বল্পবিত্ত, স্বল্পশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্ভয় কর্তব্যপালন করিতেছেন। যদি সকল স্তরের সরকারি কর্মী এমন নিঃশঙ্ক, নির্লোভ হইয়া কেবল আপন কাজটি করিয়া যাইতেন, তাহা হইলে ভারত না জানি কেমন দেশ হইত!
সকল শ্রেণির মানুষ একটি সরকারি কার্যক্রমে যোগ দিলে তাহার গতি ও বিস্তার সকল প্রত্যাশাকে ছাপাইয়া দিতে পারে। পোলিয়ো টিকাকরণ কার্যসূচিকে কার্যত ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প হইয়া উঠিতে হয়। যে সকল শিশু সরকারি নথিতে নাই, যে সকল জনপদ সরকারি চিকিৎসার নাগাল কখনও পায় নাই, পোলিয়ো টিকাকরণ তাহাদের অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিল সরকারি পরিষেবায়। সেই প্রক্রিয়া সহজ হয় নাই। বহু পরিবার সরকারের উদাসীনতায় ক্ষুব্ধ হইয়া, অথবা টিকা সম্পর্কে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হইয়া, প্রতিষেধক প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল। স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখিলে কেহ শিশুকে লুকাইয়াছিল, কেহ বা তাঁহাদের গ্রাম হইতে তাড়াইয়াছিল। প্রশাসন বুঝিয়াছিল, বলপ্রয়োগে লাভ হইবে না। পোলিয়ো টিকা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করিতে বহু কাঠখড় পুড়াইতে হইয়াছে। জনস্বাস্থ্য প্রকল্পের রূপায়ণ যে জনগণের সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণ ভিন্ন সম্ভব নহে, জনস্বার্থ সুরক্ষিত করিতে হইলে আগে জনমত তৈরি প্রয়োজন, সেই সত্য রাজনীতি ও প্রশাসন নূতন করিয়া উপলব্ধি করিয়াছিল। উপকার করিবার অধিকারও অর্জন করিতে হয়।
পোলিয়ো টিকা সম্পর্কে মানুষের ভীতি দূর করিবার জন্য যে বিপুল প্রচার চলিয়াছিল, প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিকা পৌঁছাইবার জন্য সংরক্ষণ-পরিবহণের যে পরিকাঠামো প্রস্তুত হইয়াছিল, যত কর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষিত হইয়াছিলেন, আজ তাহার প্রতিদান মিলিতেছে। সকল গ্রাম, সকল সম্প্রদায়ের মানুষ শঙ্কা-সন্দেহ ভুলিয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অগ্রাহ্য করিয়া শিশুকে টিকাদানের জন্য আনিতেছেন। সকল সরকারি প্রকল্পের নিকট পোলিয়ো টিকাকরণ আদর্শ হইতে পারে। আশাকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্তব্যনিষ্ঠাও সকল সরকারি আধিকারিকের নিকট একটি দৃষ্টান্ত।