ঘরে ফিরিবার পথে লকডাউনের পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা সংবাদ হইতে সরিয়াছে। কিন্তু আনলক পর্বে কর্মস্থলে শ্রমিকমৃত্যু ঘটিয়াই চলিয়াছে। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক অবশ্য কলিকাতায় এক শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুকে বলিয়াছেন ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। তিনি না জানিয়া ভুল করিলেন, না কি জানিয়া-বুঝিয়াও মিথ্যা বলিলেন, তাহা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু তাঁহার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা লইয়া বিতর্ক নাই। কর্মরত অবস্থায় যন্ত্রে গোলযোগের কারণে ধড় হইতে মুণ্ড বিচ্ছিন্ন হইয়া প্রাণ হারাইয়াছেন ওই শ্রমিক। ২০ জানুয়ারির ওই ঘটনার তদন্তে পুলিশ জানিয়াছে, ট্যাংরা এলাকার ওই কারখানাটি কোনও সুরক্ষাবিধিই পালন করিত না। আপাতত কারখানাটি বন্ধ হইয়াছে। সুরক্ষাবিধি মানিয়া চলে, এমন কলকারখানা কতগুলি? গত কয়েক মাসে যাদবপুরের শ্রীকলোনিতে লেদ মেশিন, বাগবাজারে মুদ্রণযন্ত্র শ্রমিকের প্রাণ লইয়াছে, কারখানায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া কয়েক জন শ্রমিক মারা গিয়াছেন। কলিকাতা পুলিশের নিকট আনলক পর্বে অন্তত বত্রিশটি শ্রমিকমৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত হইয়াছে। দুর্গাপুরের সগরডাঙায় বুকে রড গাঁথিয়া, গোন্দলপাড়া চটকলে পাটের বোঝা চাপা পড়িয়া শ্রমিকমৃত্যুও এই সময়েই ঘটিয়াছে। জেলাগুলিতে এমন আরও কত শ্রমিক প্রাণ হারাইয়াছেন, তাহার হিসাব মেলা মুশকিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুসংবাদ পুলিশের নিকট পৌঁছাইবার পূর্বেই মৃতের পরিবারকে ‘ক্ষতিপূরণ’ দিয়া বিষয়টি চাপা দেওয়া হইয়া থাকে। শ্রম আধিকারিকরা দুর্ঘটনার কারণে আহত-নিহতদের হিসাব রাখিতেছেন, সুরক্ষাবিধি লঙ্ঘন করিলে কঠোর হইতেছেন, এমন দৃষ্টান্ত সহজে চোখে পড়িবে না।
ইহা অপ্রত্যাশিত নহে। শ্রমিকের সুরক্ষার প্রতি সরকার বরাবরই উদাসীন, কিন্তু এখন সুরক্ষাবিধি বস্তুটিকেই শিথিল করিবার সকল চেষ্টা চলিতেছে। তাহার অনেকটাই করিতেছে সরকারি দফতর, লিখিত বা অলিখিত নির্দেশ জারি করিয়া। কারখানা পরিদর্শন করিতে হইলে আগাম জানাইয়া যাইতে হইবে পরিদর্শককে, বা অনিয়মের অভিযোগ আসিলে তবেই পরিদর্শন হইবে, এমন নিয়ম শ্রম আধিকারিকদের নিরুৎসাহ করিতেছে। কেন্দ্রের শ্রম মন্ত্রকও শিল্পকে ‘সহজ’ করিবার যে সকল বিধি প্রচলন করিয়াছে, তাহাতে শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা সংক্রান্ত বিধিগুলি ক্রমাগত দুর্বল হইয়াছে। যথা, নূতন উদ্যোগ (‘স্টার্ট আপ’) সূচনায় কয়েক বৎসর মালিকপক্ষ নিজেই নিজেকে সুরক্ষা বিধি বিষয়ে শংসাপত্র দিবে। কর্মীদের ঝুঁকি রহিল কি না, তাহা বুঝিতে কোনও পরিদর্শন, মূল্যায়ন হইবে না। এ কথা সত্য যে, সূচনাপর্বে বিবিধ সরকারি ছাড়পত্র আদায় করিতে হয়রান হইতে হয় বহু শিল্পোৎসাহীকে। তাহাদের কাজ সরল করা প্রয়োজন। কিন্তু, নিরাপত্তার বিধিগুলির পালন কি কেবল শিল্পোৎসাহীর সদিচ্ছার উপরে ছাড়িয়া দেওয়া চলে? একটি হিসাব অনুসারে, ভারতে প্রতি বৎসর অন্তত চল্লিশ হাজার মৃত্যু কর্মস্থলে ঘটিয়া থাকে। শ্রমিকের সুরক্ষায় সরকারকে নজরদারি করিতেই হইবে।
নূতন শ্রম আইন সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিধি আরও শিথিল করিয়াছে। দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের সরকারি ব্যবস্থাও ক্রমশ দুর্বল হইতেছে। ইএসআই হাসপাতাল পরিষেবা, তাহার সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রমিকসংখ্যা সঙ্কুচিত হইতেছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে, বিশেষত ঠিকাদারের অধীনে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যরক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা কার্যকর করা যায় নাই। এমনকি, সরকারি সংস্থাগুলিও শ্রমিক সুরক্ষায় উদাসীন। বানতলায় কেএমডিএ-র নির্মীয়মাণ জল পরিশোধনাগারের নিকাশি নালায় এক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটিল এই মাসে। সেফটি বেল্ট, অক্সিজেন মাস্ক প্রভৃতি সুরক্ষা সরঞ্জামের কিছুই রাখা হয় নাই। এই উপেক্ষা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। শ্রমিকের মূল্য কতখানি, ভারতীয় রাষ্ট্র মানিতে নারাজ।