গত সওয়া এক বৎসর বিভিন্ন পর্বে লকডাউন চলায় বায়ুদূষণে খানিক রাশ টানা সম্ভব হইয়াছিল। কিন্তু জলদূষণের ক্ষেত্রে চিত্রটি ইহার ঠিক বিপরীত। জানা গিয়াছে, লকডাউন পর্বে ভারতের প্রধান নদী গঙ্গার দূষণ কমে নাই, বরং বৃদ্ধি পাইয়াছে। এক অসরকারি পরিবেশ-গবেষণা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ, প্রধানত অপরিশোধিত এবং আংশিক পরিশোধিত তরল বর্জ্য সরাসরি গঙ্গায় মিশিবার কারণেই তাহার এই দুর্দশা। গত ছয় বৎসরে নিকাশি পরিশোধন প্লান্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে ঠিকই, কিন্তু ইহার মধ্যে সব কয়টি কর্মক্ষম অবস্থায় নাই। ফলে, বর্জ্য পরিশোধনের কাজটি যথাযথ হইতেছে না। প্রসঙ্গত, ভারতে দিনপ্রতি তরল নিকাশি বর্জ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের স্থান চতুর্থ। সমস্যা হইল, এই রাজ্যে উৎপাদিত তরল বর্জ্যের ২০ শতাংশেরও কম পরিশোধিত হইয়া থাকে। অর্থাৎ, অপরিশোধিত বর্জ্য গঙ্গায় মিশিবার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকাটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নহে।
অথচ, গঙ্গার দূষণ মুক্তি লইয়া ইতিপূর্বে প্রতিশ্রুতির বন্যা বহিয়াছে। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে বসিবার পরেই বিস্তর ঢাকঢোল পিটাইয়া কুড়ি হাজার কোটি টাকার ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রকল্পের প্রস্তাবগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ-সহ চার রাজ্যে গঙ্গার ধারে ‘নদী সংরক্ষণ ক্ষেত্র’ গড়িয়া তোলা হইবে, যেখানে কোনও প্রকার নির্মাণকার্য চলিবে না। গঙ্গায় যাহাতে কঠিন বর্জ্য এবং নিকাশি নালার জল আসিয়া না পড়ে, তাহার জন্য নদী ধারের জেলাগুলিতে ব্যবস্থা করা হইবে। এমনকি নদীতীরে বৃক্ষরোপণ, এবং দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলির উপর নিয়মিত নজরদারি করা হইবে। বাস্তবে দেখা গেল, এই আমলের অন্য প্রকল্পগুলির ন্যায় ইহাতেও ঢাক যে পরিমাণে বাজিয়াছে, কাজ সেই অনুযায়ী অগ্রসর হয় নাই। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট ২০১৮ সালেই জানাইয়াছিল, মোদীর আমলে গঙ্গার দূষণ আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট চালানো ব্যয়সাপেক্ষ বলিয়া তাহা অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধ করিয়া দিতে হইতেছে। প্রশ্ন, বরাদ্দ বিপুল অর্থ তবে কোন খাতে ব্যয় হইল?
প্রশ্ন আরও আছে। গঙ্গাজলের নির্মলতা রক্ষার দাবি নূতন নহে। ২০১১ সালে এই দাবিতে হরিদ্বারের কনখলে দীর্ঘ অনশনে আত্মবলি দিয়াছিলেন একাধিক সন্ন্যাসী। বিহারে ‘গঙ্গামুক্তি আন্দোলন’-এরও বক্তব্য ছিল, গঙ্গার নির্মলতার জন্য অবিরল ধারা বজায় রাখিতে হইবে। তাহা হয় নাই। বরং নদীর পার্বত্যধারায় কিছু দূর অন্তর বাঁধ দিয়া তাহার গতি রুদ্ধ করা হইয়াছে, ধ্বংস করা হইয়াছে দুই ধারের অরণ্য। গোড়ায় যদি গলদ থাকে, তবে কোনও প্রকল্প সফল হইতে পারে কি? অববাহিকায় ইহার সঙ্গেই যোগ হইয়াছে চাষজমি হইতে বহিয়া আসা কীটনাশক, কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক। উপনদীগুলি একই ভাবে দূষিত। গঙ্গা নির্মল হইবে কী রূপে? গঙ্গায় ভাসিয়া আসা কোভিড-আক্রান্তদের দেহ দূষণ বৃদ্ধি করিয়াছে কি না, তাহা প্রমাণিত নহে। কিন্তু ইহা স্পষ্ট করিয়া দেয় যে, এই দেশে নদীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে ঔদাসীন্য বিপুল। সরকার এবং নাগরিক— উভয় পক্ষের এই নিদারুণ ঔদাসীন্য অবিলম্বে দূর না হইলে গঙ্গা বিপন্নতর হইবে। পতিতপাবন গঙ্গা নিজের দূষণ বহিয়াই বিধ্বস্ত হইবে।