মাঝে তিনটি বছর। নীরব মোদীর ১৪,০০০ কোটি টাকার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই ফের প্রতারণার কবলে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (পিএনবি)। এ বার অভিযোগের তির আইএল অ্যান্ড এফএস তামিলনাড়ু পাওয়ার-এর দিকে। প্রতারণার পরিমাণ ২০৬০ কোটি টাকা। ব্যাঙ্ক ইতিমধ্যেই ঋণটিকে অনাদায়ি সম্পদ ঘোষণা করেছে। ঋণখেলাপির আরও এক সাম্প্রতিক উদাহরণ গুজরাতের এবিজি শিপইয়ার্ড সংস্থার ২২,৮৪২ হাজার কোটি টাকা। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া-সহ মোট ২৮টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্ক এই খেলাপির ভুক্তভোগী। অর্থাৎ, সমস্যা কোনও একটি সংস্থার নয়, কোনও একটি ব্যাঙ্কেরও নয়— সমস্যা কাঠামোগত।
ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময় থেকেই অনাদায়ি ঋণের সমস্যা ভারতে ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রাথমিক ভাবে কারণটি যদি আর্থনীতিক হয়ও, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক সংযোগ ও সাঙাততন্ত্র হয়ে ওঠে তার প্রধান চালিকাশক্তি। ব্যবসায়িক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নিজেদের বাঁচাতে বড় সংস্থার কর্তারা রাজনৈতিক যোগসাজশ কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে পুনরায় ঋণের ব্যবস্থা করেন। এই ঋণ অনেক সময় ব্যবহার করা হয় পুরনো ঋণের সুদ মেটানোর জন্য। বহু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থার আর্থিক অবস্থা কিংবা প্রকল্পের যৌক্তিকতা বিচার না করে ঋণ দিতে বাধ্য হয় ব্যাঙ্কগুলি। তা ছাড়া, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি মার খেলে, সেই ক্ষতি কী ভাবে পূরণ করা যাবে সেই বিষয়েও ব্যাঙ্কগুলির তেমন কোনও পরিকল্পনা থাকত না। ফলে বাড়তে থাকে তাদের অনুৎপাদক সম্পদ। বিজয় মাল্য থেকে নীরব মোদী, প্রতিটি কেলেঙ্কারিতেই একটি কথা স্পষ্ট— যাঁরা কোটি কোটি টাকার ঋণ না মিটিয়ে চম্পট দিয়েছেন, দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। ফলে, তাঁদের ঋণযোগ্যতার হিসাব কষার সাহস অথবা ইচ্ছা ব্যাঙ্কগুলির হয়নি।
ব্যাঙ্কের এই অনুৎপাদক সম্পদ কী ভাবে কমানো যায়? একটি বিকল্প হতে পারে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ। বেসরকারি ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের তুলনায় কম। তার অন্যতম কারণ, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ঝুঁকি, সংস্থার আর্থিক পরিস্থিতি কিংবা ওই প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা যাচাই করে তবেই কোনও সংস্থাকে বড়সড় ঋণ দেয় তারা। অন্য পথ হল, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির উপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস। ব্যাঙ্কের শীর্ষে সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত পেশাদার কর্তৃপক্ষ থাকলে, অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হবে। ব্যাঙ্ক কর্মীদের আরও পেশাদার করা প্রয়োজন, যাতে তাঁরা প্রয়োজনে ধরতে পারেন কোনও প্রকারের জালিয়াতি। এ ক্ষেত্রে উৎসাহভাতা তাঁদের এই কাজে আগ্রহ বাড়াবে। চাই উন্নত প্রযুক্তি যা এই ধরনের জালিয়াতি ধরার ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে। পাশাপাশি ব্যাঙ্কের নিজস্ব ইন্টারনাল রেটিং এজেন্সি থাকা উচিত, যা সংশ্লিষ্ট সংস্থার আগের আর্থিক লেনদেন যাচাই করে বলতে পারবে, সংস্থাটিকে ঋণ দেওয়া যাবে কি না। মোট কথা, কোনও প্রার্থী ঋণ পাবেন কি না, এই বিচারটিকে অন্য কোনও বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হতে দেওয়া যাবে না। নচেৎ, বিপদ অব্যাহত থাকবে।