Narendra Modi

নামমাত্র নহে

ইউনিয়ন সরকার বনাম সেন্ট্রাল সরকার বিতর্ক কেবল ‘নামমাত্র’ বিতর্ক নহে, ইহা একটি রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধার প্রকল্প।  

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২১ ০৫:৫৭
Share:

ফাইল চিত্র।

তামিলনাড়ুর ডিএমকে সরকারের সৌজন্যে একটি গুরুতর প্রশ্ন আবার তর্কবিতর্কের পরিসরে আসিতেছে। ভারতের রাজধানীতে ক্ষমতাসীন যে সরকার গোটা দেশের শাসনভার সামলায়, তাহার নামটি ঠিক কী? হিন্দিতে ও বাংলায় দিল্লির জাতীয় সরকারকে প্রথমাবধি ‘কেন্দ্রীয়’ সরকার বলিয়া চিনিয়া আসিলেও ইংরেজিতে কিন্তু গোড়া হইতেই দুইটি বিশেষণ প্রচলিত— ‘ইউনিয়ন’ গভর্নমেন্ট এবং ‘সেন্ট্রাল’ গভর্নমেন্ট। সরকারি দলিলপত্রে দুইটি নামই চলিয়া থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে। তবে সময়ের সহিত প্রথমটির ব্যবহার ক্রমেই সঙ্কুচিত হইয়াছে, এবং শেষ কয়েক বৎসরে প্রথম নামটি যেমন বিলুপ্তপ্রায়, তাহার অর্থ ও ব্যঞ্জনাও উল্লেখযোগ্য ভাবে সঙ্কুচিত। সাত দশক আগে যে সম্ভাব্য বিপদটির যুক্তিতে ভারতের সংবিধান-প্রণেতাগণ সতর্ক ভাবে ‘সেন্ট্রাল’ শব্দটির বদলে ‘ইউনিয়ন’ শব্দটিকে গুরুত্ব দিয়াছিলেন, সেই বিপদটিই এখন ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবে মূর্ত হইয়া উঠিতে বসিয়াছে। সুতরাং, নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরোধী দলের পক্ষ হইতেই যে এই বিষয়ে শোরগোল উঠিল, তাহাকে মোটেই আকস্মিক ঘটনা বলা চলে না— ইহার নেপথ্যে রহিয়াছে রাজনীতির সঙ্কট, রাষ্ট্রের চরিত্র-সঙ্কট। অনেক হোমওয়ার্ক কষিয়াই তামিলনাড়ুর শাসক দল ডিএমকে সরকারি কাগজপত্র হইতে মোদী সরকারের ‘কেন্দ্রীয়’ অভিধাটি বাদ দিয়া ‘ইউনিয়ন’ অভিধা, এবং দ্বিতীয়টির উপযুক্ত তামিল শব্দ ‘ওন্দ্রিয়া’ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত লইয়াছে, এবং প্রত্যাশিত ভাবেই সেই রাজ্যের বিজেপি বিপুল প্রতিবাদে সরব হইয়াছে।

Advertisement

সংবিধানের সূচনা ও মূলেই যদি ভারতকে ‘ইউনিয়ন’ বলিয়া ঘোষণা করা হইয়া থাকে— তাহা হইলে কেন সেই শব্দ হইতে এত ধারাবাহিক বিচ্যুতি, কেন আজিকার এই প্রতিবাদ? দুইটি প্রশ্নকে আলাদা ভাবে বিচার করা দরকার। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলিতে হয়, সংবিধানে যেমন ভারতকে তাহার বিবিধ অংশের সম্মিলন ভাবিয়া কেন্দ্রীয় সরকারকে সেই ইউনিয়ন বা সমগ্রের দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছিল, তেমন বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনা হইতে সরিয়া আসিয়া ইউনিটারি বা কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের পরিসরও তৈরি করা হইয়াছিল। দেশভাগ-উত্তর স্বাধীন দেশের নেতৃবৃন্দ স্বভাবতই সদ্যোজাত দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ভাবনাকে তাহার সম্পূর্ণতায় গ্রহণ করিতে চাহেন নাই। ফলে ভারতকে পুরাপুরি ফেডারাল ব্যবস্থা বলা চলে না। কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও যৌথ তালিকার বিষয়ের সংখ্যা কিংবা তুলনামূলক গুরুত্বই বলিয়া দিবে এই ইউনিটারি-ফেডারাল দ্বিধান্বিত অস্তিত্বের বাস্তব। এই প্রেক্ষাপটেই দেখিতে হইবে দেশের জাতীয় সরকারকে ক্ষেত্রবিশেষে কেন্দ্রীয় সরকার বলিবার, এবং সেই ভূমিকায় দেখিবার প্রবণতাটিকে।

তবে সাম্প্রতিককালে বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে রাজ্যের হাতে প্রদত্ত ক্ষমতাকে খর্ব ও খণ্ডন করিতে প্রমত্ত হইয়াছে, রাজ্যের অধিকারের উপর সর্বতোভাবে কেন্দ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার যে দস্তুর দাঁড়াইয়াছে— তাহাতে বিষয়টি এখন একটি অন্য মাত্রায় উন্নীত। অধিক তথ্যখননের প্রয়োজন কী— সাম্প্রতিক জিএসটি-সংস্কার, কৃষি-সংস্কার আইন এবং শিক্ষা-সংস্কার আইনের দিকে তাকাইলেই পরিস্ফুট হয়, রাজ্যের অধিকার কী ভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সামনে আজ দলিত, অবনমিত। যে সকল রাজ্য বিজেপি-শাসিত, সেখানে বিনা প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার এই অসাংবিধানিক প্রতাপ মানা হইতেছে। যে সকল রাজ্য বিজেপি-বিরোধীদের শাসনে, সেখানে ক্ষোভ-বিক্ষোভের ঝড় বহিতেছে। তাই তামিলনাড়ুর এই সরকারি পদক্ষেপের সহিত অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত, নিট-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা তামিল ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় লইবার দাবিটি। সব মিলাইয়া ইউনিয়ন সরকার বনাম সেন্ট্রাল সরকার বিতর্ক কেবল ‘নামমাত্র’ বিতর্ক নহে, ইহা একটি রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধার প্রকল্প।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement